আরেক রকম ● দশম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ● ১-১৫ আশ্বিন, ১৪২৯

প্রবন্ধ

জনজাতির স্বজনঃ ভেরিয়ার এলউইন

সৃজা মণ্ডল




‘From the unreal, lead me to the real’ - এই দর্শনে নিজেকে জারিত করে ইংল্যান্ডবাসী এক যুবক পাড়ি দিয়েছিলেন স্বপ্নের দেশ ভারতবর্ষে। এই দেশের জনজাতিদের কল্যাণের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এই যুবকের সামনে ভেসে উঠেছিল তাদের দুঃখ-আনন্দ-নৈরাশ্য-পরিপূর্ণতা। সম্মুখীন হয়েছিলেন বাস্তব সত্যের অভিজ্ঞতার।বলেছিলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য আদিবাসিদের উন্নয়ন এবং সংহতি... তবে আদিবাসি জীবনের সামঞ্জস্যকে বিপন্ন করে নয়’ - এই মানুষটিই হলেন ভেরিয়ার এলউইন। নৃবিজ্ঞানের প্রথাগত শিক্ষায় এলউইন শিক্ষিত হননি। কিন্তু ভারতের জনজাতির কল্যাণকর্মে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি। হয়ে উঠেছিলেন ভারতের অন্যতম প্রধান নৃতত্ত্ববিদ, যার জীবনে প্রবাহিত হয়ে চলেছিল এক অন্তর্লিন চিরপ্রবহমান জীবনদর্শন।

২৯ অগাস্ট। সাল ১৯০২। ইংল্যান্ডের কেন্ট ডোভারে জন্মগ্রহণ করেন হ্যারি ভেরিয়ার হলম্যান এলউইন। তাঁর বাবা এডমণ্ড হেনরি এলউইন ছিলেন সিয়েরো লিওনের অ্যাংলিক্যান বিশপ। এলউইনের সাত বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যু তাঁর জীবনে বয়ে নিয়ে এল এক অপূরণীয় শূন্যতা। হৃদয়ের শূন্যতা পূরণে, জীবনের প্রতি আগ্রহ ফেরাতে এলউইনের মা যিশুর আশ্রয় নিলেন।এলউইন প্রথমে পশ্চিমের চেলতেনহামের ডিন ক্লোজ স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলের গ্রন্থাগারে বইয়ের রাজ্যে ডুবে গেলেন তিনি। ইংরেজি কবিতার মূলধারা ও উপধারার সন্ধানে মেতে উঠলেন। সন্ধান পেলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থের রহস্যময় সর্বেশ্বরবাদের। ১৯২১-এ তিনি পড়তে যান অক্সফোর্ডে। ইংরেজি সাহিত্য এবং ধর্মতত্ত্ব দুই বিষয়েই পেলেন ফার্স্ট ক্লাস। মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি অক্সফোর্ডের উইনক্লিফ হলের ভাইস-প্রিন্সিপাল হন। অক্সফোর্ড জীবনের শেষ বছরগুলোতে এক আধ্যাত্মিক চিন্তা এলউইনকে আচ্ছন্ন করে তোলে। ভারতবর্ষের সঙ্গে এলউইনের পরিবারের দীর্ঘদিনের যোগাযোগ। তাঁর মনে হয় তাঁদের পরিবার থেকে অন্তত একজন মানুষ ভারতবর্ষে যাক, কোনকিছু পাবার আকাঙ্খা নিয়ে নয়, শুধু সে দেশটির দরিদ্রতম মানুষকে সেবা করতে; যে দেশটি ব্রিটিশ শাসনে অবনত, সেই অবনত দেশের মানুষেরই স্বজন হয়ে উঠতে। সেই সুযোগ এল মিশনারি জ্যাক উইন্সলোর হাত ধরে। তিনি ছিলেন 'খ্রিস্ট সেবা সংঘ' নামক এক আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা। খ্রিস্ট সেবা সংঘে যোগদানের জন্য এলউইন ভারতের পুনে শহরে আসেন। সাল ১৯২৭।

সেই সময়ে ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার। দেশবাসীর নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের এক অভূতপূর্ব জাগরণ, যা এর আগে বিশ্বের কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে দেখা যায়নি। ১৯২৮-এর জানুয়ারিতে সবরমতি আশ্রমে এলউইনের সঙ্গে গান্ধিজির প্রথম সাক্ষাৎ। এলউইনের কথায় খুঁজে পাই তাঁর প্রথম দর্শনের অভিব্যক্তি - ‘...Gandhi walked in almost unearthly dignity and beauty. That was the first thing that struck me about him - his beauty, and the inner spiritual power that transformed his frail body and filled the entire place with kindliness and love (Elwin, 1964:42)। ১৯২৮ থেকে ১৯৩২ - ভেরিয়ার এলউইন মহাত্মা গান্ধি ও তাঁর অনুগামীদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। এই সময়পর্বের অভিজ্ঞতাই হয়ে উঠেছিল এলউইনের সমগ্র জীবনে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বেরিয়ে আসবেন খ্রিস্ট সেবা সংঘ থেকে, কোনো একটি রিক্ত নিঃস্ব গ্রামে বসবাস করবেন, চেষ্টা করবেন সেখানকার মানুষের নিবিড় সান্নিধ্য অর্জনের। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন গুজরাটে অস্পৃশ্যদের মধ্যে কাজ করবেন। কিন্তু সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বললেন, গুজরাট ইতিমধ্যেই পরিকীর্ণ সমাজসেবী আর মিশনারি প্রতিষ্ঠানে, সেখানে এলউইনের নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ হবেনা। তিনি তাঁকে উপজাতিদের মধ্যে কাজ করার পরামর্শ দেন। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সঙ্গী যমনালাল বাজাজের মুখে এলউইন শুনলেন ‘গোণ্ড’ উপজাতিদের কথা। তাঁরই অনুপ্রেরণায় মধ্যপ্রদেশের এই চরম অবহেলিত আদিবাসি জনগোষ্ঠীর মধ্যে কাজ করতে এলউইন উৎসাহিত হলেন। তরুণ এলউইনের সামনে উন্মোচিত হল এক নতুন দিগন্ত।

১৯৩২-এর ২৮ জানুয়ারি ভেরিয়ার এলউইন ও তাঁর বন্ধু শামরাও হিভালে গরুর গাড়িতে রওনা দিলেন মধ্যপ্রদেশের মাণ্ডলা জেলার করনজিয়া নামক গোণ্ড গ্রামের উদ্দেশ্যে। ১৯৩২ সালে তিনি ইংল্যান্ডে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কিন্তু সরকারি কর্মকর্তারা তাঁকে ভারতে ফেরার অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। অবশেষে কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে তারা রাজি হয়। প্রতিশ্রুতি পত্রে স্বাক্ষর করে এলউইনকে ঘোষণা করতে হয়েছিল যে তিনি তাঁর কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণত সীমাবদ্ধ রাখবেন গোণ্ডদের মধ্যে; আইন-অমান্য বা অন্য কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করবেন না; রাজনৈতিক বিক্ষোভে যারা সামিল হবেন তাঁদের থেকে তিনি নিজেকে যতদূর সম্ভব দূরত্বে রাখবেন এবং সরকারবিরোধী কোনো লেখালিখি তিনি করবেন না।

ভারতে ফিরে এলউইন ও শামরাও ফ্রান্সিসিয় ও গান্ধিবাদী ভাবাদর্শের মিশ্র ভিত্তিতে ছোট একটি আবাসিক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করলেন গোণ্ডদের গ্রামে। গড়ে তুললেন 'ক্ষুদ্র সেবাকর্মী বাহিনী'। প্রথমে সংগঠনের নাম ছিল ‘গোণ্ড সেবা মণ্ডল’। ১৯৪৯ সালে এর নামকরণ হয় ‘Tribal Welfare & Research Unit (TWRU)। করনজিয়ার অভিজ্ঞতার কথা এলউইন লিখেছেন, ‘Leaves from the Jungle: Life in a Gond Village’ (১৯৩৬) গ্রন্থে। ১৯৩৬-এ এলউইন ও শামরাও চলে গেলেন সহওরোছাপার উপত্যকায়। বাইগা জনজাতিদের গ্রাম। সেখানে গড়ে তুললেন কুষ্ঠরোগীদের হোম। বাইগাদের কাছে ‘অরণ্য আনন্দময়’, ‘অরণ্য শুভ আকাঙ্ক্ষার ভূমি’। এই অরণ্য তাদের প্রথমজীবনের প্রেম-ভালোবাসার আবাস; এই সেই ক্ষেত্র যেখানে তারা অকুতোভয়ে লড়াই করে। এখানে এসে এলউইন প্রথম উপলব্ধি করেন এই মানুষদের স্বাধীনতাহীনতার অপরিসীম বঞ্চনা। লিখলেন, ‘The Baiga’ (1939)। বইটির মুখবন্ধে তৎকালীন সেন্সাস কমিশনার জে. এইচ. হাটন (1939:xxi) লিখেছিলেন, ‘anthropology has waited a hundred years for a full account of the Baiga, but Mr. Elwin has paid the debt as fully as any single author could who had to work on a tribe after its tribal life and organization had largely gone’. এরপর এলউইন কাজ করেন আগারিয়া গোষ্ঠীর মধ্যে। তারা কামার, লোহা গলায়। আগারিয়াদের নিয়ে লেখা তাঁর বইটি প্রকাশ পায় ১৯৪২ সালে। নাম ‘The Agaria’.

সেই সময়ে সেন্ট্রালে প্রভিন্স বলে পরিচিতি প্রদেশটির দক্ষিণে ছিল বাস্তার রাজ্য। বাস্তারের প্রতি এলউইনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন স্যার ডব্লু. ভি. গ্রিগসন, যিনি ভারতের আদিবাসি সমস্যার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন আপনজন হয়ে। ১৯৪০ সালের মে মাসে সেন্সাস অফিসার হিসাবে এলউইন বাস্তারে এলেন। দক্ষিণের বাইসন হর্ন মারিয়া আর উত্তরের মুরিয়াদের ওপর তথ্য সংগ্রহ করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। মারিয়াদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তাদের বিবাহ-নৃত্য। সেই নৃত্যানুষ্ঠানে পুরুষদের মাথায় থাকে মোষের শিঙের শিরস্ত্রাণ, গলায় ঢোলক; তারপর তারা ঘুরতে ঘুরতে একটি বড় বৃত্ত রচনা করে; আর মেয়েরা সেই বৃত্তের মধ্যে ঘোরে। আদিবাসী ভারতবর্ষে এ এক অতুলনীয় নৃত্যসুষমা। দরিদ্র, নিঃস্ব আদিবাসি মানুষ নৃত্যের ছন্দে পরমাবিষ্ট হয়ে খুঁজে পায় জীবনের এক তাৎপর্য।

মুরিয়া উপজাতিদের মধ্যে এলউইন দেখলেন ঘোটুলের উপস্থিতি। ঘোটুল বা গ্রামের ডরমিটরি মুরিয়া জীবনের কেন্দ্রবিন্দু, সাংস্কৃতিক বিকাশের দ্যোতক। ঘোটুলের মূলকথা যৌবনকে কার্যকর করা - বস্তুগত চাহিদার চেয়ে মুক্তি ও সুখকে বড় করে দেখা - বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা, পরোপকারিতা ও ঐক্যচেতনাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। এই অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন ‘The Muria and their Ghotul’ (1947) গ্রন্থে।

এরপর তাঁরা এলেন পাটানগড়ে। এখানে দাতব্য চিকিৎসালয়, স্কুল, কুষ্ঠাশ্রম স্থাপন করলেন। ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে এলউইন প্রথম ওড়িশায় যান। তাঁর কাজ ছিল বোনাই, কেওনঝড় ও পাল লহরার আদিবাসি অঞ্চল পরিদর্শন করে সেখানকার মানুষের জীবনচর্চার ওপর অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণ করা। এই প্রসঙ্গে তাঁর একটি ব্যক্তিগত মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন।একদিন রাতে তিনি পাল লহরায় জুয়াং উপজাতিদের গ্রামে গিয়ে দেখেন বৃদ্ধা মহিলারা কটিদেশে এক টুকরো নেকড়া জড়িয়ে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় মাটির মেঝেতে কুঁকড়ে শুয়ে কম্পমান অগ্নিশিখা থেকে যৎসামান্য উত্তাপ সংগ্রহের আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এই জুয়াংদের প্রায় সকলেরই স্বাস্থ্য অত্যন্ত খারাপ, নানা ব্যাধিতেও তারা আক্রান্ত। ওড়িশা সফরের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটলো তাঁর তিনটি গ্রন্থেঃ ‘Bondo Highlander’ (1950), সাওরাদের নিয়ে ‘The Religion of an Indian Tribe’ (1955) এবং ‘Tribal Myths of Orissa’ (1954)।

ভেরিয়ার এলউইন নিজেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বলেছেন - ব্রিটিশ বর্ন ইণ্ডিয়ান অর্থাৎ ইংল্যান্ডে জন্মানো ভারতীয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু পরে, তরুণ বয়েসেই তিনি ভারতে এসেছিলেন। কিন্তু সম্পূর্ণ অজানা এই দেশ তাঁকে আবিষ্ট করে ফেলে। গোণ্ড জাতির সমাজ, তাদের যৌথ জীবনযাপনের অবিশ্বাস্য ধরণ, তাদের সুখী থাকার ক্ষমতা - এলউইনকে নতুনভাবে চিন্তা করতে শেখায়।এবং সাধারণ মানুষকে সেই আশ্চর্য অভিজ্ঞতার সঙ্গী করতে বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী বিষয়ে তিনি লিখতে শুরু করেন। এই কথারই আমরা প্রতিফলন পাই ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ-র কথায়, যিনি (১৯৯৬:২৩৭৬) লিখেছিলেন, ‘a self-taught and self-trained anthropologist, Elwin ranged widely over the Indian heartland, studying and writing about tribes in the British ruled territories of Orissa, Bihar and the Central Provinces, as well as the large tribal chiefdoms of Bastar. His travels bore fruit in a series of ethnographies and folklore collections for ‘academic’ consumption, and in numerous policy pamphlets, reports, and newspaper articles for a more general audience...’

এলউইন বলেছিলেন, আদিবাসিরাই তাঁকে আনন্দ ও সরলতার গুরুত্ব শিখিয়েছে।  বর্ণ ও ছন্দের প্রতি তাদের আসক্তি তাঁর মনে প্রত্যক্ষভাবে সাড়া ফেলেছিল। বাইগারা তাঁকে গহীন অরণ্যের সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছিল। কুট্টিয়া কোণ্ড ও মারিয়ারা তাঁর মধ্যে সৌন্দর্য চেতনার প্রজ্জ্বলন ঘটিয়েছে। সাওরাদের নিয়ে তিনি চিন্তাভাবনা করেছেন, তাদের ভালোবেসেছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন নৃবিজ্ঞানের যথার্থতা লুকিয়ে আছে মানুষের প্রতি ভালোবাসায়। তাই তিনি লিখেছিলেন (১৯৬৪:১৪২), ‘The essence and art of anthropology is love. Without it, nothing is fertile, nothing is true.’ তিনি আরও বলেন, ‘For me anthropology did not mean field work’: it meant my whole life. My method was to settle down among the people, live with them, share their life as far as an outsider could, and generally do several books together. My Baiga book took me seven years, The Agaria ten. I spent my ten years on my first collection of folktales and fourteen on the Folk songs of Chhatisgarh. And they were all going on at the same time. This meant that I did not depend merely on asking questions, but knowledge of the people gradually sank in until it was part of me. And with knowledge came the desire to help’.

এলউইনের মানুষকে জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল সাহিত্যপাঠের সূত্রে। ধর্মতত্ত্ব নিয়ে তাঁর পড়াশোনা মানুষ সম্বন্ধে কৌতূহল বাড়িয়ে তুলেছিল। তিনি লিখেছেন, ‘The science of God led me to the science of human beings’ (Elwin, 1964:141). এ. এইচ. কুইগগিন (quoted in Elwin, 1964:140) লিখেছিলেন যে, ‘His anthropology might be called Philanthropology. His great service to science was to lay the foundations and to build the framework of anthropology well and truly on sound scientific principles; his service to humanity was to show that ‘the proper study of mankind’ is to discover Man as a human being, whatever the texture of his hair, the colour of his skin or the shape of his skull’.

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভের পর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ভারতের উত্তরপূর্ব কোণে বসবাসকারী উপজাতিদের সমস্যা সমাধানের জন্য অনুরোধ জানালেন এলউইনকে। নেহেরু বলেছিলেন, ‘As a matter of fact, I have learned much from him, for he is both an expert on this subject with great experience and a friend of the tribal folk. I have little experience of tribal life and my own views, vague as they were, have developed under the impact of certain circumstances and of Verrier Elwin’s own writings. It would therefore, be more correct to say that I have learned from him rather than that I have influenced him in any way’ (quoted in Bera, 2008:42). ভারত সরকার এলউইনকে ১৯৫৩ সালে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত সংস্থার (North East Frontier Agency) উপজাতি বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত করে। তাঁর বই ‘A Philosophy for NEFA’ (1957) ভারত সরকারের উপজাতীয় নীতি এবং উপজাতীয় উন্নয়ন প্রশাসনে নতুন পথ খুলে দিয়েছিল। নেফার উন্নয়ন, প্রগতি ও কল্যাণের জন্য এলউইন পাঁচটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেনঃ
প্রথমত, আদিবাসিদের জমি নিঃশর্তে ওদেরই থাকবে।বহিরাগতদের কাছে আদিবাসি-জমি হস্তান্তর বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আদিবাসিদের অরণ্যের অধিকার মেনে নিতে হবে। তৃতীয়ত, আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এবং সমবায় আন্দোলনে জোর দিয়ে ঋণ জর্জরতার সমস্যার সমাধান করতে হবে। চতুর্থত, আদিবাসি এলাকায় শিল্পায়নের সমস্যাকে অবশ্যই অধিক গুরুত্বে বিবেচনা করতে হবে। যেক্ষেত্রে আদিবাসিরা ভূমিচ্যুত, অন্যত্র বসবাস করছে, সেক্ষেত্রে ওদের ক্ষতিপূরণ দানে উদ্যোগ নিতে হবে। আর সবশেষে, আদিবাসিদের সরকারি চাকরির সব সুযোগ দিতে হবে।

এই প্রসঙ্গে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পণ্ডিত জি. বি. পন্থ এলউইন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘It has been the great work of Dr. Elwin to raise the status of trial people in public opinion all over India. He has shown us that they are not just backward people but have an art and a culture of their own, and so has influenced the policy of the whole country’ (quoted in Mandelbaum, 1965).

১৯৬০ সালে এলউইনকে তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি কমিশনের সদস্য হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছিল।ভেরিয়ার এলুইন বলেছিলেন, ‘পাহাড় ও সমতলের ঐক্য জাতীয় স্বার্থেও যেমন প্রয়োজন, তেমন প্রয়োজন পাহাড় ও অরণ্যের মানুষদের স্বার্থে। আমরা পরস্পরকে সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় করতে পারি। আদিবাসিদের আমরা অনেক কিছু দিতে পারি, আবার ওদেরও অনেক কিছু আছে, যা আমাদের দেবার মতো’।

ভেরিয়ার এলউইনের বিপুল কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালে আমরা দেখি তিনি ছাব্বিশটি নৃতাত্ত্বিক বই লিখেছেন, যার মধ্যে চোদ্দটি ভারতীয় উপজাতির মনোগ্রাফ, সাতটি সাধারণ বই, দুটি উপন্যাস এবং তাঁর আত্মজীবনী। লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ। নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ১৯৫১ সালে 'এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল' ভেরিয়ার এলউইনকে 'অ্যানানডেল' পদকে ভূষিত করে। ১৯৫৪ সালে তিনি ভারতীয় নাগরিক হন। ভারতে উপজাতিদের অধ্যয়নের ক্ষেত্রে অসামান্য কীর্তির জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি. এস. সি. ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৬১ সালে ভারত সরকার তাঁকে 'পদ্মভূষণ' উপাধিতে সম্মানিত করে।

এই প্রবাদপ্রতিম নৃতাত্ত্বিকের চিরবিদায়ের দিনটি ছিল ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৪। বৌদ্ধধর্মের সরল একটি রূপ এলউইনের জীবনে এক আধ্যাত্মিক চেতনার বিস্তার ঘটিয়েছিল। তাই, পরের দিন, অর্থাৎ, ২৩ ফেব্রুয়ারি শিলং-এ তাঁকে বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুযায়ী দাহ করা হয়। ভেরিয়ার এলুইন ছিলেন একজন উদার, মুক্তমনা এবং সত্যের সন্ধানে আগ্রহী মানুষ। তাঁর মৃত্যুতে ভারতের আদি জনগোষ্ঠী হারাল একজন আন্তরিক স্বজনকে।

এই বছর এলউইনের ১২০তম জন্মবার্ষিকী। মনে প্রশ্ন জাগে, এত বছর পরেও আমরা এলউইনকে কেন মনে করব? কারণ, আগে আদিবাসিদের তকমা দেওয়া হত বন্য বর্বর হিসেবে। প্রচলিত ধারণায় ওরা এক পৃথক শ্রেণির মানুষ, ওরা হয়তো আমাদের মনে সদয় করুণা জাগাতে পারে, কিন্তু মুগ্ধ শ্রদ্ধা জাগ্রত করতে পারে না। এলউইন চেয়েছিলেন আদিবাসিদের সবাই জানুক, চিনুক। সবাই ওদের স্নেহ ও শ্রদ্ধা করুক। এলউইনের হাত ধরেই আমাদের সামনে উঠে এল আদিবাসিদের যাপনচিত্র, তাদের সংস্কৃতি। তবে, এলউইন শুধুই ভারতের আদি জনজাতির কথা লেখেননি, তাদের কল্যাণকর্মে স্থাপন করেছিলেন দাতব্য চিকিৎসালয়, স্কুল, কুষ্ঠাশ্রম। সর্বোপরি, ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আদি জনজাতি মানুষজনের আত্মসম্মান, ওদেরও যে কেউ ভালোবাসে, সেই অনুভব। এলউইনের বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের প্রতিফলন আমরা পাই বিখ্যাত ব্রিটিশ শিল্প ইতিহাসবিদ ডব্লিউ. জি. আর্চার-এর লেখা ‘The Plains of the Sun’ বইয়ের একটি কবিতায় -
Among your burning hills, the lonely jungle
Roars in the summer. The sterile land
Rests; and news comes up like clouds
While you are active in the needs of peace
Saving the gestures of the happy lovers
The poems vivid as the tiger
Faced with destruction from the septic plains
And with your love and art delay
The crawling agony and the death of the tribes.


তথ্যপঞ্জিঃ

● Bera, Gautam Kumar. 2008. Passage through Aboriginal India: Anthropological Profile of Verrier Elwin. Allahabad: The Oriental Institute of Cultural and Social Research.

● Devi, Mahasweta and Prithwis Saha. 2000. Verrier Elwin-er Adivasi Jagat. New Delhi: Sahitya Akadeni.

● Elwin, Verrier. 1957. A Philosophy for NEFA. (With a Foreword by Jawaharlal Nehru). Shillong: North East Frontier Agency.

● Elwin, Verrier. 1964. The Tribal World of Verrier Elwin: An Autobiography. Bombay: Oxford University Press.

● Guha, Ramachandra. 1996. Savaging the Civilized: Verrier Elwin and the tribal question in late colonial India. EPW. Special Number. September. 2375-2389.

● Guha, Ramachandra. 2014. Savaging the Civilized: Verrier Elwin, His Tribals and India. Gurgaon: Allen Lane an imprint of Penguin Books.

● Hutton, J. H. 1939. Foreword. The Baiga. London: John Murray.

● Mandelbaum, David G., 1965. ‘Verrier Elwin 1902-1964’. American Anthropologist, Vol-67(2):448-452.
https://www.jstor.org/stable/i227429