আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

এই সমাজ, এই সমাজমাধ্যম

সুগত ত্রিপাঠী


বিশেষ একটি সমাজমাধ্যম (ফেসবুক/মুখপুস্তক) নিয়ে আজকাল অনেকে অনেক রকম কথা বলে থাকেন। এ জিনিস ছেলেময়েদের মাথা খেয়ে নিচ্ছে, ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে উঠছে, উল্টোপাল্টা লোককে 'ফ্রেন্ড' বানাচ্ছে, প্রেম করছে, প্রেম করতে গিয়ে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছে, আত্মহত্যা করছে - ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরাই নয়, বিভিন্ন বয়সের সমাজের নানান স্তরের মানুষ উক্ত সমাজমাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। চলছে কমেন্ট বক্সে অশ্লীল খিস্তি-খেউড়ের দাপাদাপি, প্ররোচনামূলক কথাবার্তা, জাতিবিদ্বেষী-ধর্মবিদ্বেষী কথাবার্তা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী উস্কানিমূলক 'পোস্ট', ব্যক্তি-আক্রমণ।

ওপরের কথাগুলির মধ্যে কিছু সত্যতা আছে - একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই সঙ্গে ভেবে দেখলে অবাক হতে হয় না কি, যিনি এই বস্তুটির উদ্ভাবন করেছিলেন? যে উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি করুন, তাঁর মস্তিষ্ক, ব্যতিক্রমী চিন্তাভাবনার প্রসারতা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। সমগ্র বিশ্ববাসীকে এ জিনিস একসূত্রে গেঁথেছে অনেকাংশে। পুরুলিয়ার অখ্যাত গ্রামের ছেলের 'বন্ধু' কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কিংবা আমস্টারডামের যুবতীর সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলেন উত্তরপ্রদেশের যুবক - পরস্পর পরস্পরকে কোনওদিন না-দেখলেও; হয়তো-বা কোনওদিন দেখবেনও না। শারীরিক দেখাসাক্ষাৎ না-হলেও ভাব আদানপ্রদানে অসুবিধে হচ্ছে না। আগে 'পত্রবন্ধু' বা 'পেন ফ্রেন্ড' বলে একটা জিনিস ছিল। বহু দূরবর্তী অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কেউ কেউ শখে পত্রমিতালী পাতাতেন। কেউ কাউকে কোনওদিনই দেখেননি, তবু যোগাযোগ-কথাবার্তা চলত চিঠি-মারফত। এই বন্ধুত্ব অনেক সময় প্রগাঢ় বন্ধুত্বেও পরিণত হত, বিপদে-আপদে সাহায্য পাওয়া যেত, যদিও সে সংখ্যা খুব কম।

এই 'পেন ফ্রেন্ড' কিংবা 'পত্রবন্ধু'রই একটা রূপান্তর হল 'ফেসবুক ফ্রেন্ড'। তবে সমাজমাধ্যমের ক্ষেত্রটা অনেক ব্যাপক। এখানে যে কেবল বন্ধুত্ব হয় তা নয়, বহুজনসমক্ষে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র তুলে ধরা যায়। এবং অতি দ্রুত, অতি অল্প সময়ের মধ্যে। ধরা যাক, কেউ কবিতা লেখেন। আগে হলে তিনি কবিতা লিখে সেটা হয় পত্রপত্রিকার দপ্তরে পাঠাতেন প্রকাশ করার জন্য, নচেৎ প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন বই হিসেবে বের করার উদ্দেশ্যে। উভয়ই সময়সাপেক্ষ, এবং অনিশ্চিত। কিন্তু এখন সমাজমাধ্যম এসে গিয়ে সে সমস্যা অনেকখানি মিটিয়েছে। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ছবি - যে যা-ই সৃষ্টি করুন না কেন, সহজেই তিনি প্রকাশ করার একটা প্লাটফর্ম পেয়ে গিয়েছেন।

এবং গোলমালটাও হয়েছে এখানেই। যখন একজন দেখেন, খুব সহজেই তাঁর লেখা প্রকাশ করতে তিনি পারছেন, সেক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টিসমূহের প্রতি যত্নশীল হওয়ার প্রবণতা তাঁর কমে যায়। এটা হয়। গোদের ওপর বিষের ফোঁড়া হয়েছে 'কমেন্ট'। যাঁরা কমেন্ট করেন, যেহেতু তাঁরা তাঁর 'বন্ধু' - তাই ভালো হোক খারাপ হোক, সবকিছুতেই 'ভালো', 'অসাধারণ', 'চমৎকার', 'অসম (awesome)' ইত্যাদি শব্দগুলি প্রয়োগ করে দেন। অনেকে আবার না-পড়েই মন্তব্য করেন। একজন এভাবে যখন অপরজনের প্রশংসা করেন, সেই অপরজনটি যখন কিছু 'পোস্ট' করেন, একই রকম প্রশংসা তাঁরও জুটে যায়। খেলাটা এভাবেই চলতে থাকে। অর্থাৎ লেখা কিংবা অন্য যে কোনও সৃষ্টির সত্যিকারের মূল্যায়ন হয় না। কিন্তু পত্রপত্রিকার দপ্তরগুলি নিরপেক্ষভাবে বিচার করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তাই সেখানে মূল্যায়ন অনেকখানি যথার্থ হয়। অবশ্য ভুল যে তাঁদেরও হয় না তা নয়, সে কথা বলতে গেলে তো একটা উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট হবে - বিভূতিভূষণের 'পথের পাঁচালী'-ও এক পত্রিকা-সম্পাদক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ফেরৎ এসেছিল 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত'-ও। তথাপি কিছু অভিজ্ঞ মানুষ যখন একটা সৃষ্টিকর্মকে বিচার করেন - সেক্ষেত্রে তার একটা মূল্য থাকে। যা খুশি তাই লিখে সমাজমাধ্যমে 'পোস্ট' করার সঙ্গে তা কখনওই তুলনীয় নয়। এর প্রত্যক্ষ ফল আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই। সমাজমাধ্যমে সরাসরি 'পোস্ট' করা অধিকাংশ লেখাই হয় নিম্নমানের। এক্ষেত্রে অনেকে একটা কথা বলে থাকেন। তাঁরা বলেন, বড় পত্রিকার 'অহংকারী' সম্পাদকের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে না লেখকদের। তাঁরা নিজেরাই নিজেদের লেখা প্রকাশ করতে পারছেন, এবং মুহূর্তে বহু পাঠকের কাছে তা চলে যাচ্ছে। কিন্তু এ ধারণা খুব ভিত্তিযুক্ত কি? সমাজমাধ্যমে লেখালেখি করে, চলচ্চিত্র আপলোড করে, ছবি এঁকে খুব প্রতিষ্ঠা কেউ এখনও পর্যন্ত পেয়েছেন কি? এই উপায়ে লেখক হিসেবে, চলচ্চিত্রকার কিংবা সার্থক শিল্পী হিসেবে কেউ সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন কিনা জানা নেই।

অবশ্য একথা অনস্বীকার্য যে, বিখ্যাত পত্রপত্রিকা এবং অভিজাত প্রকাশনীগুলিতে দুর্নীতি রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। যোগ্যতর ব্যক্তিকে হঠিয়ে অযোগ্য ব্যক্তির লেখা বহু ক্ষেত্রে সেখানে ঠাঁই পেয়ে যায়। কারণটা ঠিক জানা যায় না, তবে অনুমান করা যেতে পারে। স্বজনপোষণের ব্যাপারটা থাকে প্রবলভাবে। সম্পাদক মশাইয়ের ঘনিষ্ঠ কিংবা সহ-সম্পাদকের 'বিশেষ' পরিচিত বা পরিচিতার সাদামাঠা লেখা অনায়াসে জায়গা করে নেয়। অখ্যাত-অজ্ঞাত লেখকদের উচ্চাঙ্গের লেখা ফেলে দেওয়া হয়। আবার কোনও কোনও পত্রিকা চৌর্যবৃত্তিও করে। লেখাটা ভালো হয়েছে, তবে লেখক যেহেতু 'পত্রিকাগোষ্ঠীর লোক' নন, তাই লেখাটা ছাপা হবে না, ওই লেখার সারাংশ সাপ্লাই করা হবে কোনও পেয়ারের লোককে, তাঁর নামে লেখাটা বেরোবে। কিন্তু ধুরন্ধর লোক তাঁরা, চুরিটা (অর্থাৎ কুম্ভীলক বৃত্তি) করেন এমন কায়দা করে, সরাসরি অভিযুক্ত করা মুশকিল। কিন্তু ব্যাপারটা আল্টিমেটলি চুরি, অন্য কিছু নয়। যাই হোক, স্বজনপোষণ সম্পর্কে একটা কথা বলে এ প্রসঙ্গের ইতি টানব। জীবনানন্দ দাশের 'ক্যাম্পে' কবিতাটি ছাপা হয়েছিল সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-সম্পাদিত 'পরিচয়' পত্রিকায়। জীবনানন্দের কবিতা সুধীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন না। আগেও জীবনানন্দ 'পরিচয়' পত্রিকায় কবিতা পাঠিয়েছেন। ছাপা হয়নি। কিন্তু 'ক্যাম্পে' কবিতাটি জমা পড়েছিল কবি বিষ্ণু দে-মারফত। সে কারণেই কবিতাটি প্রকাশিত হয় কিনা কে জানে। আর একটা কথা ভেবে দেখতে বলি। পত্রিকাগোষ্ঠীর অপরিচিত এক লেখক পাঠিয়েছেন একটি প্রবন্ধ, আবার পত্রিকার মালিক অথবা সম্পাদকের শ্যালক পাঠিয়েছেন একই বিষয়ের ওপরে আর একটি প্রবন্ধ। সম্পাদক মশাই বুঝতে পেরেছেন প্রথম প্রবন্ধটির মান অনেক উন্নত। তথাপি দ্বিতীয়টি-ই নির্বাচিত হয়ে যায়। কোন সাহসে তিনি স্ত্রী-কে চটাবেন শ্যালকের প্রবন্ধ বাতিল করে? আবার অনেক সময় পত্রিকা-সম্পাদকের অবিচারের শিকার হতে হয় লেখকদের, প্রধানত নবীন লেখকদের। অনেক পত্রিকা-সম্পাদকের মনে এরকম একটা ধারণা আছে, তাঁরা লেখকদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। যেন তাঁরা লেখা না-ছাপলে লেখকের জীবন অন্ধকার। এটা ভুলে যান, লেখকের যেমন পত্রিকা কিংবা প্রকাশনীর প্রয়োজন, পত্রিকা কিংবা প্রকাশনীরও তেমনই লেখককে প্রয়োজন। পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তথাপি বহু খ্যাতিমান সম্পাদকের নাক-উঁচু মনোভাব প্রকাশ পেতে দেখা যায়। সমাজমাধ্যমে এসব ঝামেলা নেই। কিন্তু সেইসঙ্গে এর গ্রহণযোগ্যতাও সেভাবে নেই, গড়ে ওঠেনি।

সমাজমাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যম - যেমন সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল ইত্যাদির 'পেজ' রয়েছে। সেখানে নানান খবর পরিবেশিত হয়। সেসব খবরের ওপর অসংখ্য মানুষ 'কমেন্ট' করেন। সেগুলি একটু খুঁটিয়ে পড়লেই বোঝা যায়, শতকরা নব্বই শতাংশই খেলো। না-আছে ভাষার ঠিক, না-আছে বক্তব্যের যুক্তি-গভীরতা। কিন্তু সুযোগটা যখন পাওয়াই গেছে, ছাড়ি কেন - এই মনোভাব। ফলস্বরূপ, 'কমেন্ট বক্স' দুর্গন্ধ আবর্জনায় পরিপূর্ণ হয়। বিভিন্ন সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষও পাঠকের মন্তব্য করার স্থান রাখেন তাঁদের কাগজে। সেখানে কেবল সুচিন্তিত মতামতই প্রকাশিত হয়। ফলে সেই মন্তব্যগুলির একটা গভীরতা, একটা ওজন থাকে। সমাজমাধ্যম এ সবকিছুকেই নস্যাৎ করে। আমি যা খুশি তাই কয়েকটা কাগজে লিখে কাগজগুলোকে যদি আঠা দিয়ে সর্বত্র 'পেস্ট' করে দিই - রেল স্টেশনে, গাছের গায়ে, বাসস্ট্যান্ডে, ল্যাম্পপোস্টে - সেটা যেমন ব্যাপার হবে, সমাজমাধ্যমে 'পোস্ট' ব্যাপারটাও মোটামুটি অনুরূপ। একটা পেস্ট, অপরটা পোস্ট।

কথাগুলো বলার প্রয়োজন হত না, যদি না অনেকে এভাবেই সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু ঘটনা হল, অনেকেই তা দেখছেন। দিবাস্বপ্ন কিনা জানি না, তবে দেখছেন। লেখক-কবির সংখ্যা তাই অকস্মাৎ সাঙ্ঘাতিক রকম বেড়ে গিয়েছে।

সমাজমাধ্যমের 'চোখে আঙুল দাদা'-র ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। যা ঘটছে, ঘটে চলেছে - সেটাই বলা হল সরলভাবে।

সমাজমাধ্যমকে লোকে কত ভাবে ব্যবহার করছে! কেউ আত্মহত্যা করছে, তার 'লাইভ টেলিকাস্ট' চলছে। কেউ আবার সমস্ত ক্ষোভ, আশা-নিরাশা-হতাশা সমাজমাধ্যমে উগরে দিয়ে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল। এখন দুর্ঘটনায় মুমূর্ষ মানুষকে বাঁচানোর পরিবর্তে একশ্রেণীর মনুষ্য নামধারী জীব সেসব ঘটনার 'ভিডিও রেকর্ডিং' করতে ব্যস্ত থাকে। উদ্দেশ্য একটাই - সেগুলি বীরপুরুষের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা এবং অজস্র 'লাইক', 'কমেন্ট' পাওয়া। মানবিকতার কতখানি অধঃপতন হয়েছে, ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়।

'ফেসবুক ফ্রেন্ড' (বা সমাজমাধ্যম-বন্ধু)-এর খপ্পরে পড়ে কতজনের যে কত সর্বনাশ ঘটে চলেছে, ইয়ত্তা নেই। প্রকৃত বন্ধুত্ব তৈরি হয় দীর্ঘ সময়ের পরে। একজন মানুষকে দেখে, শুনে, কথাবার্তা বলে, তার সঙ্গে মনের মিল হলে তবেই বন্ধুত্বের প্রশ্ন। সমাজমাধ্যমের বাটন-টেপা বন্ধুত্বের সঙ্গে নিশ্চয়ই তা এক আসনে বসতে পারে না। ফলও দিচ্ছে সেরকম। 'বন্ধু'-র হাতে ধর্ষিতা হচ্ছে মেয়েরা। ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স উধাও করে দিচ্ছে 'বন্ধু'। নানান অসামাজিক, কুৎসিত কাজকর্ম, যৌনাচার চলছে সমাজমাধ্যমের হাত ধরে।

এরই মধ্যে স্বল্পসংখ্যক কিছু মানুষ রয়েছেন, যাঁরা কিন্তু সমাজমাধ্যমকে একটা সৎ জায়গা হিসেবেই ধরেন। এর সাহায্যে যে বহু জ্ঞানীগুণীর কাছে পৌঁছোনো যায়, সেই বোধটা এঁরা মাথায় রাখেন। তাই তাঁদের প্রকাশিত অর্থাৎ পোস্ট করা বস্তুগুলিও হয় উন্নত মানের। অনেকেই ফেসবুকে চমৎকার কবিতা লেখেন, গল্প লেখেন, স্বকণ্ঠে সঙ্গীত-আবৃত্তি; নৃত্য, নাটক - এসবও প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু এঁদের সংখ্যা বড়ই অল্প।

এসব ক্ষেত্রে সমাজমাধ্যম কর্তৃপক্ষও দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না। এটাকেও যদি একটা আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরতে হয়, সেক্ষেত্রে এখানেও নির্বাচকমণ্ডলী, সম্পাদকমণ্ডলীর প্রয়োজন। কেউ কোনও কিছু পোস্ট করতে চাইলে আগে তাঁরা দেখবেন জিনিসটা প্রকাশের উপযুক্ত গুণমানসম্পন্ন হয়েছে কিনা। তারপরে তাঁরা প্রকাশের অনুমতি দেবেন। তা না-হলে 'আজ বান্ধবীর মেয়ের রিসেপশন', 'রাত্রে কড়াইশুঁটির কচুরি বানাব', 'চললাম দার্জিলিং' জাতীয় পোস্ট থামানো যাবে না। অশালীন কিংবা উস্কানিমূলক কিংবা অন্য যে কোনও রকম অনভিপ্রেত পোস্ট করলে কর্তৃপক্ষ তা বাতিল করতে পারেন। মোটকথা একটা ফিল্টার বা ছাঁকনি প্রয়োজন। সেটা না-হলে যেহেতু সবাই জানেন যে, যা খুশি তাই লিখে পোস্ট করার সুযোগ সমাজমাধ্যমে আছে, তাই কেউ সমাজমাধ্যমের লেখাকে গুরুত্ব দেবেন না। যাঁরা সিরিয়াস মানুষ, গভীরতায় বিশ্বাসী, গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেন - তাঁরা কেউ কিন্তু সমাজমাধ্যমকে বিশেষ পাত্তা দেন না। এখানে প্রকাশিত কোনওকিছুই তাঁরা প্রায় ছুঁয়েও দেখেন না। এ নিতান্ত চটুল মানুষদের জায়গা হয়ে গিয়েছে। অবস্থা কিংবা ব্যবস্থার যদি কিছু পরিবর্তন না-হয়, তাহলে কিন্তু লেখক-কবি-শিল্পীরা যদি এই প্লাটফর্মকে আত্মপ্রকাশের জায়গা হিসেবে বেছে নেন, তাঁরা কিন্তু খুব বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেবেন না। সেক্ষেত্রে 'সোশ্যাল মিডিয়া? ও তো যা খুশি তাই করার জায়গা' - এই মনোভাবেরই ধারক-বাহক হয়ে থাকবে সমাজমাধ্যম। সৃষ্টিশীল মানুষের কাছে এই অভিধা মঙ্গলজনক নয়। তবে উপরোক্ত কড়া তথা যথাযথ ব্যবস্থা নিলে সমাজমাধ্যমরূপ ব্যবসায় যে বিশাল মন্দার সৃষ্টি হতে পারে, সে কথাও ঠিক। ফেসবুক-অ্যাকাউন্ট ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন বহু মানুষ।

প্রসঙ্গক্রমে বলি, ভেবে দেখলে অবাক হতে হয়, শিক্ষিত মানুষজন পর্যন্ত শ্বশুরবাড়িতে জামাইষষ্ঠীর ভোজ খেতে গেছেন, সেই সব খাদ্যসামগ্রীর ছবি তুলে ফেসবুকে নামিয়ে দিয়েছেন। পুজোর ভাসানের সময় অসভ্যের মতো নাচছেন, সেটাও 'ফেসবুক-পোস্ট' করার বিষয়! এঁরা বোধহয় বোঝেন না, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনচর্যা অন্যের আগ্রহের বিষয় না-ও হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে বিরক্তিরও উদ্রেক করতে পারে। 'ফেসবুক-ফ্রেন্ড'-এর সবাই তো সবার ক্ষেত্রে আর পরিচিত মানুষ নন। সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকজনও আছেন। সেক্ষেত্রে কী করে এই জাতীয় ব্যক্তিগত বিষয়ের ছবি সর্বসমক্ষে একজন শিক্ষিত মানুষ আনেন, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় বইকি।

অবশ্য অন্যান্য নানাবিধ ক্ষেত্রে সমাজমাধ্যমের প্রভূত প্রভাব রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি-ব্যক্তিগত - নানান মানুষের নানান কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাচ্ছে সমাজমাধ্যমে। জনগণ বুঝতে পারছেন কালসাপেদের প্রকৃত চরিত্র। ফলে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষদের মনে কিছুটা ভীতিরও সঞ্চার হয়েছে। পায়াভারী লোকের বেইজ্জতি যে বড় লজ্জাজনক! আবার ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে সমাজমাধ্যম নানান অনর্থ সৃষ্টি করছে কিছু মানুষের হাতে পড়ে। 'সম্পর্কে-থাকা' নর-নারীর মধ্যে গোলমাল হলে একে অপরপক্ষকে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি 'ভাইরাল' করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। এই করে বহু নারী-পুরুষের জীবন ছারখার হয়ে গিয়েছে ‌‌‌। অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছেন লজ্জায়, অপমানে, ভয়ে। আবার কাউকে চরম অপমান করার দৃশ্য ভাইরাল হয়ে গিয়েছে, যার কোনও প্রয়োজন ছিল না। সংশ্লিষ্ট অপমানিত ব্যক্তিটি অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণায় দিন কাটিয়েছেন। এমনও দেখা গিয়েছে, নির্দোষ ব্যক্তিও নির্যাতিত হয়ে সেই দৃশ্যে 'ভাইরাল' হয়ে গিয়েছেন। কোভিড-কালে কিছু অত্যুৎসাহী পুলিশকর্মী কোনও কোনও মানুষকে কোভিড-বিধি লঙ্ঘন করার অপরাধে কান ধরে উঠবস করিয়েছেন। মানবাধিকার বিরোধী এই জাতীয় কাজকর্ম করার অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে, কে জানে। তাঁরা একবারও ভেবে দেখলেন না, প্রকাশ্য স্থানে এই জাতীয় 'শাস্তি' প্রদানের ছবি ভাইরাল হলে মানুষগুলির মনের অবস্থা কী হবে। সমগ্র বিশ্বের মানুষের কাছে সেসব ছবি কিছু কিছু চলে গিয়েছে।

গুজব ছড়ানো কিছু মানুষের চিরকালীন অভ্যেস। এটা খেলে ওই রোগ সারে, এটা মাখলে এই হয়; ওই জায়গার 'স্থানমাহাত্ম্য' অসীম, গেলেই সর্বার্থসিদ্ধি; এই রত্নপাথর হাতে থাকলে কোনও বিপদ-আপদ হবে না - জাতীয় সংবাদের অহরহ প্রকাশ সমাজমাধ্যম জুড়ে চলে। লজ্জার বিষয়, বহু প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমও নিজেদের 'ফেসবুক পেজ'-এ নানান মুখরোচক সংবাদ পরিবেশন করে, ব্র্যাকেটে লিখে দেয় - 'সত্যতা যাচাই করেনি সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্র কিংবা টিভি চ্যানেল'। এভাবে দায় থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় কিনা জানি না। প্রকারান্তরে এ হল সত্যের অপলাপ। কেবল সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়োনোর চেষ্টা - কোনও কোনও অতি-প্রতিষ্ঠিত বিস্কুট কোম্পানি যেমন মাঝে মাঝে লেড়ো বিস্কুটের প্যাকেট বার করে 'ব্যাপক সেল'-এর উদ্দেশ্যে।

সমাজমাধ্যমে যে কেবল একাউন্ট খোলা যায় তাই নয়, চ্যানেল পর্যন্ত খুলে ফেলা যাচ্ছে (যেমন: ইউটিউব চ্যানেল)। যাঁদের বলার কিছু নেই, দেওয়ার কিছু নেই - সেইসব বন্ধ্যা লোকজনও একটা চ্যানেল খুলে ফেলছেন ইয়ার্কি মেরে। যদি কিছু 'সাবস্ক্রাইবার' জোটে। অর্থাৎ সবাই বিখ্যাত হতে মরিয়া। কুখ্যাতির মাধ্যমেও যদি বিখ্যাত হওয়া যায়, তাতেও অনেকের আপত্তি নেই। তাই কেউ স্রেফ অশ্লীল খিস্তি-খেউড় আপলোড করছেন নিজস্ব চ্যানেলে, কেউ আবার অর্ধউলঙ্গ হয়ে নাচছেন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের চরিত্রহনন করছেন - তাঁদের সম্পর্কে উল্টোপাল্টা-ভুলভাল-চমকপ্রদ কথাবার্তা বলে নজরে আসার চেষ্টা করছেন। সম মানসিকতাসম্পন্ন কিছু লোকজনের বাহবাও জুটে যাচ্ছে। চ্যানেলওয়ালা ভাবছেন, ফাটিয়ে দিলাম! সত্যিকারের সাফল্য যে এত সহজে আসে না, এই মূর্খদের কে বোঝাবে।

একটু আগে যে প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছি, কিঞ্চিৎ বিস্তারিত করার প্রয়োজন বোধ করি। কিছু অতিখ্যাত গণমাধ্যম অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে দিনের-পর-দিন কুৎসিত যৌন-সংবাদ পরিবেশন করে চলেছে। সঙ্গম চলাকালে কী কী কথা বললে সঙ্গী বা সঙ্গিনী অধিকতর উত্তেজিত হয়, সঙ্গমের আগে ভরপেট জল খেলে সঙ্গম দীর্ঘস্থায়ী হয় কিনা, লিঙ্গোত্থানের যুগান্তকারী পদ্ধতি জাতীয় চরম ইতর সংবাদ কোনও কোনও বঙ্গসংস্কৃতির 'পুরোধা'রূপ সংবাদপত্র পরিবেশন করে। পাঠকরা যথেচ্ছ গালাগালি দেন, কিন্তু তাঁদের লজ্জা নেই। পরের দিন আবার এক-ই ধরনের সংবাদ পরিবেশিত হয়। এইসব সংবাদের অধিকাংশই যেমনই অশালীন, তেমনই মিথ্যা। অপরিণতবয়সী ছেলে-মেয়েদের হাতে এ জাতীয় সংবাদ স্মার্টফোনের মাধ্যমে পড়লে, অভিব্যক্তি কী হতে পারে, বলাই বাহুল্য। সমাজ কলুষিত করার পবিত্র দায়িত্ব যেন নিয়েছে কিছু গণমাধ্যম। কেবল ধান্দাবাজি, নিজেদের আখের গোছানো, ব্যবসা বাড়ানো। টিআরপি-র পেছনে ছোটা। নিয়ম-নীতি বিসর্জন দিয়ে এই প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। সেইসঙ্গে ছাপা হচ্ছে যৌন উত্তেজক ছবি। নারীশরীরের অশালীন প্রদর্শনী। উদ্ভট সব সংবাদও পরিবেশিত হয়। হিন্দি সিনেমার কোন নায়িকা গর্ভবতী, সেটাও একটা খবর! তাঁর স্ফীত উদরের ছবি ফলাও করে ছাপা হয়। সন্তান জন্মগ্রহণের পরে, সেই বাচ্চার পেছনে পড়ে থাকেন সাংবাদিককুল। সে কী খেল, কী করল - দিনের-পর-দিন চলে সেসব নিয়ে আলোচনা-চর্চা। আবার যিনি যা বলেননি, তাঁর মুখে সেইসব কথা বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রায় সবই নিন্দাসূচক। এই চিত্রপরিচালক এই অভিনেতা সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন - এরকম সংবাদ পরিবেশিত হওয়ার পরে দেখা গেল, সংশ্লিষ্ট চিত্রপরিচালক এবং অভিনেতা দুজনেই অবাক। কারণ এরকম কু-মন্তব্যের সাক্ষী তাঁরা কেউ নন। অনেকে বিভিন্ন গণমাধ্যম, সমাজমাধ্যম মারফত এর প্রতিবাদও করেছেন। আর একটা জঘন্য তথা চরম আপত্তিকর-ক্ষতিকর ব্যাপার চলছে - 'মহাপুরুষের বাণী' নাম দিয়ে স্বরচিত 'বাণী' কিংবা অন্য কারও কথা প্রচার করা হচ্ছে। ব্যাপারটা অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য করতে সেই মহাপুরুষের ছবি লেখার সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

তবে একটা কথা অনস্বীকার্য যে, সমাজমাধ্যম আসার পরে বিভিন্ন মানুষ নানান বিষয় নিয়ে কী ভাবেন, তার একটা রূপরেখা পাওয়া যাচ্ছে। আগে এই পাওনা ছিল সংক্ষিপ্ত - পরিচিত মহল, দোকান-বাজার, ট্রেন-বাস, স্কুল-কলেজ, অফিস ইত্যাদিতে হওয়া স্বল্পসংখ্যক মানুষের মতামত। এখন যে কোনও একটা বিষয়ের ওপরে গোটা পৃথিবীর মানুষ কী ভাবেন, তার একটা সন্ধান পাওয়া যায়।

আবার যন্ত্রণাদায়ক সংবাদে বহু মানুষের সহমর্মিতার প্রকাশ দেখা যায়। এমনকি অর্থাভাবে কোনও ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম, সমাজমাধ্যমের মাধ্যমেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার বার্তা দেন অনেকে। দুরারোগ্য রোগগ্রস্তকে অর্থসাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। অনাথ শিশুকে লালন-পালনের দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন - কন্টাক্ট নাম্বার পর্যন্ত দিয়ে দেন।

সমাজমাধ্যমে নানান মানুষের নানান রকম মানসিকতার পরিচয়ও পাওয়া যায়। হয়তো কোনও মহিলা সমাজমাধ্যমে দুটো-চারটে কথা বলেছেন কোনও পুরুষের সঙ্গে মজা করে, অমনি পুরুষপুঙ্গব তাঁকে মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছেন, 'ইনবক্স প্লিজ'।

এই মাধ্যম মানুষকে সচেতন করার ভূমিকাও পালন করে। কী ভাবে প্রতারণার চক্র বিছিয়েছে প্রতারকেরা - ভুয়ো কল-সেন্টার খুলেই হোক, কিংবা জাল অ্যাপস ডাউনলোড করিয়েই হোক - সে বিষয়ে সংবাদ পরিবেশিত হলে মানুষ সাবধান হতে পারেন।

আবার সমাজমাধ্যমে, অন্তর্জালে যেহেতু পাওয়া-যায়-না, এমন কোনও জিনিস প্রায় নেই, তাই বোমা-পিস্তল তৈরীর কৌশল, গলায় ফাঁস লাগানোর কৌশল কিংবা ড্রাগস নিলে মানুষের কত 'আনন্দ' হয় - সে-সবও এখন সুলভ।

কেবল ফেসবুক নয়, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ব্লগ, ইউটিউব, পিন্টারেস্ট, টিকটক, স্ন্যাপচ্যাট - অজস্র সমাজমাধ্যমের জালে বিমোহিত বিশ্ববাসী। এসব সম্পর্কে (অর্থাৎ সমাজমাধ্যম সম্পর্কে) শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। ভবিষ্যৎ-ই তা বলবে।