আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

জিমখানার কথা

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী


দিনগত পাপক্ষয়ের পরে নাগরিক ক্লান্তি নিয়ে যখন বাড়ি ফেরার জন্য মেট্রো স্টেশন লাগোয়া অটোর লাইনে দাঁড়াই, যখন সারা শরীর ভিজে যায় ঘামে, বাড়ি ফিরে মগের পর মগ জল গায়ে ঢালার জন্য প্রাণ আকুল হয়, তখন দেখি স্টেশন লাগোয়া একটা দুতলা জিম-বাড়িতে ইয়াব্বড় ওজন তুলছেন কয়েকজন লোক। জিম-বাড়ির দেওয়ালগুলো কাচের। ফলে অন্দরমহল একেবারে পরিষ্কার। ফ্লুরোসেন্ট রঙের টিশার্ট পরা একজনকে প্রায়ই দেখি। প্রজাপতির পাখার মতো উনি দুটো হাত একবার বুকের সামনে আনেন। হাতের মধ্যে ড্রিল জাতীয় কিছু। সেই হাত দুটো একবার পিঠের পিছনে যায়। আবার সামনে আসে। সেই কিম্ভুত রঙের গোলগলা টি-শার্টের উপরে জ্বলজ্বল করে - সিক্স প্যাকস কামিং সুন। ওঁর পাশে রাখা বেশ কয়েকটি ট্রেডমিলে টানা দৌড়ে চলেন কয়েকজন যুবক-যুবতী। দৌড়ে চলে বার্মুডা, হট প্যান্ট, দামি ব্র্যান্ডের জুতো। লক্ষ্য করে দেখেছি, দুধসাদা এমন জুতোয় ধুলো নেই মোটে। জুতোগুলো শুধু ধ্বস্তাধ্বস্তি করে ট্রেডমিলের অভিজাত চলমান রবারে। তাতে রাস্তার কালিমা লাগে না। জিম-বাড়ির সামনে রাখা বিরাট ফ্লেক্স কিংবা ব্যানারে মাংসপেশী দেখিয়ে ঝলমল করেন, আগুন ঝরান কোনও বিদেশি বডি বিল্ডার। পেশীর এমন ত্রিমাত্রিক ত্রিকোণমিতি দেখলে আমাদের ঘরের মনোহর আইচরা হয়তো বড্ড লজ্জা পেতেন। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টোয় যত, এমন জিম-বাড়ির সংখ্যা তত বাড়ে। বেড়েই চলে।

এত পর্যন্ত ঠিক ছিল। শারীরিক কসরৎ করার অধিকার আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু তার উপরে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে বেশ কয়েকটা মৃত্যু। জিম করতে করতেই আচমকা ঝরে যাচ্ছেন, এমন মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। সম্প্রতি প্রাণ হারিয়েছেন কলকাতার বাঁশদ্রোণী অঞ্চলের এক কলেজছাত্রী। বয়স মাত্র ১৯ বছর। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে মাদুরাইয়ের এক জিমে সেদিনের ওয়ার্কআউট শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরে মৃত্যুর পরে ঢলে পড়েছিলেন ২৭ বছরের এক যুবক। অভিনেতা পুনীত রাজকুমারের কথা হয়তো অনেকেই বিস্মৃত হয়েছেন। গত বছর তিনিও প্রাণ হারান জিম করাকালীন। বছর আটেক আগে, অভিনেতা আবীর গোস্বামী চিরঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলেন এই জিম করার সময়েই। এদিক ওদিক থেকে এমন হঠাৎ প্রাণহানির খবর আসছে ক্রমশ। অবশ্য যত প্রাণহানি হয়, তার কটিরই বা খবর আসে!

প্রশ্ন উঠছে, পয়সার বিনিময়ে জোর করে ঘাম ঝরানোর জন্য যেখানে যাই আমরা, সেখানে আমি কতটা যোগ্য তা জানার জন্য কেউ চেষ্টা করছেন না কেন? অনেকেই কপাল কুঁচকে বলছেন, যে দেশে দু' বছরের শিশুকেও প্লে-স্কুলে ভর্তি করানোর আগে শিশুটিকে দশটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, সেখানে জিমে ভর্তি করার সময় তো কোনও প্রশ্নই করা হয় না। জানতে চাওয়া হয় না এই বাড়তি শারীরিক কসরতের জন্য মানুষটির শরীর সায় দিতে আদৌ প্রস্তুত কি না। ট্রেডমিলে তিনি শরীর ‘গরম’ করবেন যখন, হৃদপিন্ডে যখন প্রবল হবে রক্ত চলাচল, তা সামলানোর জন্য পোক্ত আছে তো তাঁর হৃদয়? আমাদের চারপাশের জিম-বাড়ির নিয়ম কানুন বলে, ভর্তি মানে শুধু অ্যাডমিশন ফি। আর সিকিওরিটি ডিপোজিট। এগুলো পকেটস্থ করা ছাড়া আর কোনও ব্যবস্থা নেই। ডাক্তারি পরীক্ষা? প্রশ্ন করাও মহাপাপ।

মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর আমাদের অঞ্চলেরই একটি জিমে ভর্তি হয়েছিলাম। রাস্তার মোড়ে হাত জোড় করে থাকা নেতানেত্রীদের বিরাট কাটআউটের রমরমা তখন ছিল না। মানুষের কাছে, মানুষের পাশে - এমন শব্দবন্ধের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার তখনও বাকি ছিল কিছুটা। এমনই এক রাস্তার এক প্রান্তে দেখেছিলাম, মাত্র ১০ দিনে দু' থেকে আড়াই ইঞ্চি মেদ কমানোর প্রতিশ্রুতি। সঙ্গে থাকা ফোন নম্বরে ভর্তির জন্য যোগাযোগ করেছিলাম। বছর কুড়ি আগের কথা। অ্যাডমিশন ফি ছিল পাঁচশ টাকা। আর প্রতি মাসে দুশো। ভর্তির জন্য ফর্ম ভরতে হয়েছিল। প্রয়োজন ছিল শুধু একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি। ভোর ছটা থেকে ক্লাস। শুনেছিলাম, বাজারের ডিমান্ডে এত ভোরে নতুন স্লট বরাদ্দ করেছেন জিম মালিক। মিনিট পনেরো অ্যারোবিক্স হল। তার পর ছাত্রছাত্রীদের চালান করে দেওয়া হল ট্রেডমিলে। আমার সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অনেকেই বিশালবপু। সিংহভাগই মহিলা। তখন স্মার্টওয়াচের যুগ ছিল না। অ্যারোবিক্সের পরে তুমুল ঘেমে এক মধ্যবয়স্কা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কত ক্যালরি ঝরল মাস্টারমশাই? শরীরে যে বল পাচ্ছিনা মোটে।’ ট্রেনারসাহেব তির্যক হেসে বলেছিলেন, ‘সবে তো কলির সন্ধে। পাক্কা দু' ঘন্টার সেশন। এত সহজে কাহিল হয়ে গেলে চলবে? মনে রাখবেন, মাত্র দশ দিনে দু-আড়াই ইঞ্চি কমানোর গ্যারান্টি।’ তাঁর ভুল ভেঙেছিল! এবারে ট্রেনারের কড়া নির্দেশে ট্রেডমিলে দৌড়তে শুরু করেছিলেন ওই মধ্যবয়স্কা। কয়েক মিনিট যেতে না যেতে উনি লুটিয়ে পড়েন রবারের চাদরে। আশ্চর্য হয়ে দেখেছিলাম, ট্রেনার নাছোড়বান্দা। মহিলাকে উঠিয়ে জোর করে এক গ্লাস জল খাইয়ে ফের একটা ওজন ঝরানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, বেশ মনে আছে। মহিলার মুখে যা প্রবলভাবে ফুটে উঠছিল তা হল বিপন্নতা। ওঁকে পরের দিন থেকে আর জিমে আসতে দেখিনি। প্রতিদিনের এই ঝঞ্ঝাটময় অভিজ্ঞতা আমার পক্ষেও সুখকর ছিল না। দু' সপ্তাহের বেশি চালাতে পারিনি। শরীরে ক্লান্তি উইয়ের ঢিপির মতো গড়ে উঠেছিল। এমন জিম-বাড়ির বাড়বাড়ন্ত আজ শহরের আনাচে কানাচে, বিরিয়ানির দোকানের মতো। বহু বছর পর ওই মহিলার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ফেসবুকে। জিমের কথা ওঠাতেই তিনি বলেছিলেন, ‘শরীরের নয়, মনের মেদটা কমানোর সাহস ছিল বলেই ছাড়তে পেরেছিলাম ওই অভিশপ্ত জিম।’ জেনেছিলাম, ওঁর হার্টে নাকি আংশিক ব্লক ধরা পড়েছিল ওই ঘটনার পরেই। ভাগ্যিস!

এক পরিচিত ডাক্তারবাবুকে বলতে শুনেছিলাম, ‘জিমে গিয়ে জোর করে গলদঘর্ম হওয়ার মধ্যেই ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে গলদ শব্দটি।’ মুড়ি মুড়কির মতো গজিয়ে ওঠা জিমে যাঁরা নাম লেখাচ্ছেন, তাঁদের ভর্তি করার সময় আদৌ কোনও চেকলিস্ট মেলানো হয় কি না তা নিয়ে ওই চিকিৎসক প্রশ্ন তুলছিলেন বারবার। অন্য এক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আমাদের এই জিমপ্রীতি বিষয়ে কথা হচ্ছিল সম্প্রতি। উনি বলছিলেন, ‘চল্লিশ পেরোলে শুধু চালসে হয় ভেবে বসলে তা হবে এক মস্ত ভুল। হৃদযন্ত্রটিও যে এত বছর ধরে ক্রমাগত কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ক্রমশ, তা আমরা ইচ্ছে করেই ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি। মধ্যপ্রদেশ বাড়লে, প্রিয়জনদের কটূক্তি গায়ে না মাখতে পেরে জোর করে নাম লেখাই কোনও বাহারি জিমখানায়। যে হৃদযন্ত্র সামান্য আদর দাবি করত এই মধ্যবয়সে, তাকে টাট্টু ঘোড়া মনে করে ওর উপর সপাং সপাং করে চাবুক চালাই। বাংলা ব্যান্ডের পরিচিত গানের মতো, - অবশেষে জেগে ওঠে শোষিতর মতো ওই আত্মিক ঘোড়া বিপথে চলে যায়, বিপদ ডেকে আনে গুরুতর। ’

জিমে গিয়ে শারীরিক কসরতের নিয়ম সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁরা বলেন, সবকিছুই করা উচিত রুটিন মেনে, ধাপে ধাপে। এত টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েছি, সুতরাং পয়সা উসুল করতে হবে পুরোমাত্রায় - এমন মানসিকতা নিয়ে যাঁরা জিমমুখো হন, শুরু থেকেই সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন ওজন কমানোর মোক্ষলাভের আশায়, তাঁরা নিজেদের বিপদ নিজেরাই আলিঙ্গন করে ডেকে আনেন। আশঙ্কার আরও কারণ হল, জিমের এমন জেদি ছাত্রদের লাগাম পরানোর জন্য যে যোগ্য পরীক্ষকদের প্রয়োজন, বাস্তবে তাঁদের বড়ই অভাব। ট্রেডমিলে উঠে যাঁরা দৌড়েই চলেন মরুতীর্থ হিংলাজের ভূতগ্রস্ত যাত্রীদের মতো, তাঁদের লাল-হলুদ কার্ড দেখানোর মতো মানুষরা বিরাজ করেন দিকশূন্যপুরে। বেসরকারি জিমে যোগ্য ট্রেনারের বেশি নিয়োগ হলে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাড়ে। বাড়ে জিম চালানোর খরচ। অক্লান্ত কোনও ট্রেডমিল আরোহী কিংবা ওয়ার্কআউটপ্রেমীকে কোন প্রহরে সতর্ক করা উচিত, তা নিয়ে বলার মতো মানুষ কতজন রয়েছেন হাল-আমলের জিমখানায়, তা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে। জনস্রোতের একাংশ যেভাবে বাঁধ ভেঙে প্রতিনিয়ত ঢুকে পড়ছেন জিমজগতে, তাঁদের ফিল্টার করার কোনও সরকারি বিধিনিষেধ আছে কি না জানি না। যদি থেকেও থাকে, কলার তুলে বলতে পারি, এমন নিয়মকানুনের প্রতি সম্মিলিতভাবে আমরা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাই।

কলেজপড়ুয়ারা তো বটেই, সমাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথাকথিত পৃথুল ব্যক্তিরাই জিম কারবারিদের পাখির চোখ। ভর্তি হইবার আগে কি ছিলেন এবং দু'মাস পরে কি হইয়াছেন, এমন দুটি ছবি পাশাপাশি রেখে প্রচার চালাতে পারলে দারুন লাভ। বডি শেমিং নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামান তাঁরা এমন ‘পণ্য’ হয়ে যাওয়া নিয়েও আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। জিমের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এমন ছবির কোলাজ উপচে পড়ে ভুরিভুরি। রোগা হয়ে আনন্দে মাতেন যাঁরা, তাঁদের কাছে হঠাৎ খুলে যায় সব পেয়েছির দেশের কোনও দরজা। সামাজিক ব্যাকরণ হয়তো বলে, শরীরে প্যাক বাড়লে ঊর্ধ্বমুখী হয় স্টেটাসও।

ফিটনেস ‘ফ্রিক’রা জিমখানার ট্রেডমিল দাপিয়ে বেড়ান। এতে কার কিই বা আপত্তি থাকতে পারে! কিন্তু ঝরে পড়ছেন যাঁরা, তাঁদের তালিকাটা আরও লম্বা হওয়ার আগে সাবধান হওয়া জরুরি। পরীক্ষার হলে অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে যাওয়ার মতো জরুরি হোক জিমে ভর্তির আগে হেলথ স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা। সবাই মিলে হাতে হাত রেখে যদি আমরা সচেতন না হই, তাহলে হয়তো আরও বড় কোনও বিপদ আসন্ন। সময়ের গর্ভে তার উত্তর লুকিয়ে রয়েছে।