আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

একজন নাগরিকের চোখে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি

দীপাঞ্জন গুহ


(১)

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের স্কুলশিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে বিপুল দুর্নীতির কথা সামনে আসছে তা দেখে আমাদের চমকে উঠতে হয়। যে চাকরিপ্রার্থীরা মাসের পর মাস রাস্তায় বসে থেকে আন্দোলন করে এবং আদালতে আইনি লড়াই করে এই দুর্নীতিকে সামনে আনছেন, সমাজ হিসাবে তাঁদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। একদিকে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা রাস্তায় বসে আছেন, অন্যদিকে তদন্তকারী সংস্থার দাবি অনুযায়ী এই দুর্নীতির থেকে প্রাপ্ত বহু কোটি টাকা কারুর বাড়ি থেকে পাওয়া যাচ্ছে (কত যে পাচার হয়ে গেছে, তা অনুমান করাও মুশকিল), বারবার টাকার পাহাড়ের ছবি ফুটে উঠছে টেলিভিশনের পর্দায়। এ যেন এক কাফকার জগতে বাস করছি আমরা!

এক্ষেত্রে প্রথমেই এটা মনে রাখা দরকার যে, এই দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে কলকাতা হাইকোর্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শ্রী রণজিৎ বাগের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার জন্য। সেই কমিটি প্রাথমিক তদন্ত করে ইতিমধ্যেই রিপোর্ট দিয়েছে যে বেআইনিভাবে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। তার ভিত্তিতে হাইকোর্ট একজন মন্ত্রীকন্যাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে এবং তার জায়গায় যে বঞ্চিত যোগ্য প্রার্থী মামলা করেছিলেন তাঁকে বহাল করেছে। সুতরাং অপরাধ যে হয়েছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, সেটা এই কমিটি আমাদের ইতিমধ্যেই জানিয়েছে। এখন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলির মূল লক্ষ্য অপরাধ হয়েছে কি হয়নি সেটা নির্ধারণ করা নয়, অপরাধের পরিমাণ এবং অপরাধীদের খুঁজে বার করা। সে চেষ্টা তাঁরা করুন, আইন আইনের পথে চলবে, অপরাধীদের খুঁজে বার করবে এবং শাস্তি দেবে, এই আশা আমাদের রাখতেই হবে, কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকের জন্য অপরাধী কে এটা প্রধান প্রশ্ন নয়, মূল কথা এটাই যে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে। এবং যেহেতু বহু সংখ্যায় সেটা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে, তাই এই অপরাধের শাখা-প্রশাখা গোটা ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত আছে বলে অনুমান করা যায়, দু-একজনের পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব নয়।

কিন্তু এই বেনিয়মের নিয়োগের বিরুদ্ধে যে ন্যায্য আন্দোলন চলছে, তার পাশাপাশি সমস্যাটির একটি মূল দিক আড়ালে থেকে যাচ্ছে, তা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হচ্ছে না। আলোচনা হচ্ছে প্রধানত এই দিকটি নিয়ে যে যোগ্য প্রার্থীরা চাকরি পাননি, অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে অযোগ্যরা চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে এর প্রভাব কতটা বিস্তৃত, এর ফলে স্কুলের শিক্ষার ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াচ্ছে, তা নিয়ে খুব একটা কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে না। আমাদের মনে রাখা দরকার এই চাকরিগুলি ছিল স্কুল শিক্ষকের, সরকারি পিয়ন বা অফিসার বা কারখানার শ্রমিক বা ইঞ্জিনিয়ারের নয়। সমাজে সমস্ত কাজেরই গুরুত্ব আছে, কিন্তু স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে অন্য অনেক চাকরির তুলনা চলে না।

যদি এই দুর্নীতির অভিযোগ সত্যি হয়, তাহলে তার অর্থ এটা দাঁড়ায় যে বহু সরকারি স্কুলের ক্লাসঘরে বহু অযোগ্য শিক্ষক ঢুকে পড়েছেন, আমাদের স্কুলের বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন। এবং যদি দুর্নীতি সত্ত্বেও এই নিয়োগ বহাল থাকে, তাহলে তাঁরা হয়তো আরো পঁচিশ তিরিশ বছর বাচ্চাদের পড়িয়ে যাবেন। কতটা অযোগ্য? অনেকে নাকি ফাঁকা খাতা জমা দিয়েও চাকরি পেয়েছেন বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। আর শুধু শিক্ষার মানের যোগ্যতা নয়, যাঁরা বহু লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে বেনিয়মে শিক্ষক হয়েছেন, তাঁরা শিশুদের প্রাথমিক মূল্যবোধের শিক্ষাই বা দেবেন কি করে? চুরি করা বা ঘুষ দেওয়া বা নেওয়া অন্যায়, একথা তাঁরা জোর দিয়ে বলতে পারবেন কি? তার মানে এই রাজ্যের আগামী তিন-দশকের স্কুল-ছাত্রদের পড়াশোনা এবং নৈতিক শিক্ষার ওপর একটা গভীর প্রশ্নচিহ্ন বসিয়ে দিয়েছে এই নিয়োগ-দুর্নীতি। এবং যেহেতু আমাদের সমাজের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীই সরকারি স্কুলের ওপর নির্ভরশীল, তাই সমাজের ভবিষ্যৎকেই ফোঁপরা করে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা হয়েছে। সমস্যার এই দিকটিই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বলে আমাদের মনে হয়। এবং তাই এটাও মনে হয়, যে-সুবিচারের জন্য এই যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা লড়াই করছেন তা আসলে শুধু তাঁদের সুবিচারের প্রশ্ন নয়, গোটা সমাজের সুবিচারের প্রশ্ন, তাই সামাজিকভাবে আমাদের এই লড়াইয়ের পাশে দাঁড়ানো দরকার।

(২)

দুষ্কৃতী বা দুর্বৃত্তরা সাধারণত লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু যদি তাদের রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী, 'সমাজসেবী' ইত্যাদি নানা ছদ্মবেশে সমাজের সামনের সারিতে ঘুরে বেড়াতে হয়, তাহলে তাদের প্রয়োজন হয় সমাজের সাধারণ মূল্যবোধগুলোকে ধ্বংস করার। যাতে মানুষ অন্তত কিছু সময়ের জন্য ন্যায়-অন্যায়ের বিভেদ ভুলে যায়, তাদের দুষ্কর্মগুলো নিয়ে মাথা না ঘামায়, আর দুষ্কৃতীরা সগৌরবে ঘুরে বেড়াতে পারে, দুষ্কর্মের জলজ্যান্ত উদাহরণ, এমন কি ভিডিও ফুটেজ থাকা সত্ত্বেও আবার নির্বাচনে দাঁড়াতে পারে।

আর যদি সমাজের সাধারণ মূল্যবোধকে ধ্বংস করতে হয়, তাহলে সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার।

শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার দুটো উপায় আছে - এক, বিভিন্নভাবে দুর্বল করতে করতে বর্তমান ব্যবস্থাটাকে তুলে দেওয়া, আর দুই, একটি নতুন ব্যবস্থা তৈরি করা, যেখানে শাসকের পছন্দমতো শিক্ষা - তা সে যতই ভুল, মিথ্যা বা অনৈতিক হোক - ছাত্রদের মাথায় গুঁজে দেওয়া, এক কথায় মগজ ধোলাই। এই দুটি উপায়েরই ব্যবহার আমরা দেখেছি 'হীরক রাজার দেশে'-তে। বর্তমানে এদেশেও শিক্ষাকে ধ্বংস করার এই ব্যবস্থার নিদর্শন আমরা দেখতে পাচ্ছি।

এ-ব্যাপারটা বোঝার জন্য ভারতের স্কুল-ছাত্রদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর এক-ঝলক নজর রাখা দরকার। ২০২১ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে কোভিডের প্রভাব নিয়ে ভারতবর্ষের ওপর একটি রিপোর্ট তৈরি করেছে ইউনেস্কো ও ইউনিসেফ। নাম 'ইন্ডিয়া কেস স্টাডি', প্রকাশিত হয়েছে অক্টোবর ২০২১-এ। সেখানে দেখা গেছে যে, গ্রামের পড়ুয়াদের মধ্যে মাত্র ৩২%, অর্থাৎ প্রতি তিন জনে এক জনের কাছে ইন্টারনেট আছে। সেখানে আরো দেখা গেছে যে ভারতের সব স্কুলছাত্রের মধ্যেও মাত্র তিন জনে এক জন কোনোভাবে পড়াশোনার কিছু জিনিস তাদের শিক্ষকদের থেকে এই সময়ের মধ্যে পেয়েছে। তাদেরও বেশিরভাগ হোয়াটস অ্যাপে, যৎসামান্য। এছাড়াও ২০২১ সালে পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশের ক্ষুধা ও দারিদ্রের অন্যতম নির্দেশক 'গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স' প্রকাশিত হয়, যেখানে ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান দাঁড়ায় ১০১। ভারতের পেছনে আছে পাপুয়া নিউগিনি, আফগানিস্তান, কঙ্গো, নাইজেরিয়া, হাইতি, সিয়েরা লিওন, ইত্যাদি কয়েকটি দেশ। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের অবস্থার নিরিখে ভারতের অবস্থা সঙ্গীন এবং প্রতি রাতে এ-দেশের অসংখ্য শিশু ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমোতে যায়।

এর থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ও বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী নিম্নবিত্ত থেকে হতদরিদ্র। তারা সম্পূর্ণভাবে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল, তাদের প্রাইভেট স্কুল বা প্রাইভেট টিউশনের কোনো সুযোগ নেই, সম্ভবত বাড়িতেও দেখিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। তাদের শিক্ষা পাওয়ার একমাত্র আশা সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা।

তাই সেই ব্যবস্থাকে দুর্বল করতে পারলে গোটা সমাজের শিক্ষা ও মূল্যবোধের স্তরকে দুর্বল করা যায়, সমাজকে পদানত রাখতে সুবিধা হয়। প্রথমত, ক্রমশ সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার বেসরকারিকরণের একটা উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, যেখানে ভালো শিক্ষা একটা পয়সা দিয়ে কেনার জিনিস হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এক কথায় পণ্যে পরিণত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বলাই বাহুল্য দেশের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীর কাছে স্কুলটাই অধরা থাকবে। ক্রমশ শোনা যাচ্ছে যে সরকারি স্কুলে ভালো পড়াশোনা হয়না। এছাড়াও দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞানশিক্ষার সঙ্গে ছদ্মবিজ্ঞানকে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, অর্থাৎ বিজ্ঞানমনষ্কতাকে ধ্বংস করে মগজ ধোলাইয়ের চেষ্টা। আর এখন এর পাশাপাশি শোনা যাচ্ছে শিক্ষক নিয়োগে এই বিপুল দুর্নীতির কথা। অর্থাৎ বাচ্চাদের পড়াশোনা শেখার প্রধান সূত্রটিই - যোগ্য শিক্ষক - ছিন্ন হতে বসেছে। অযোগ্য, দুর্নীতিপরায়ণদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে আমাদের সমাজের শিশুদের।

আমাদের, অর্থাৎ এদেশের সাধারণ নাগরিকদের, প্রধানত এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা দরকার শিক্ষক নিয়োগের এই দুর্নীতিকে। আর সেটা দেখলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে এক্ষেত্রে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তা যদি সত্যি হয়, তবে তা শুধু যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের জন্য নয়, গোটা সমাজের জন্যই একটি ভয়ঙ্কর সংকেত। এটি নৈতিক মূল্যবোধহীন এবং অশিক্ষিত একটি সমাজ তৈরির চক্রান্ত এবং সেরকম একটি সমাজ শুধুমাত্র সমাজবিরোধীদেরই স্বর্গরাজ্য হতে পারে, বাকি সব নাগরিকের জন্যই তা হবে ভয়ঙ্কর। আর তাই এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সদাজাগ্রত থাকা প্রয়োজন।