আরেক রকম ● দশম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৯

সমসাময়িক

দুর্গতিনাশিনী?


মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণা ও উদ্যোগে বঙ্গের জনগণ আবারও একবার এক অননুকরণীয় কর্মের সাক্ষী হইতেছেন। বাংলার আবহমানকালের উৎসব দুর্গাপূজা লইয়া এক মহাযজ্ঞের আয়োজন অধুনা সরকারের উদ্যোগে সংগঠিত হইতেছে। বাঙালি জনতা হঠাৎ করিয়া দেখিতেছেন বারোয়ারী পূজার জন্য দুর্মূল্য সরকারি কোষাগার হাট করিয়া খুলিয়া গিয়াছে। কেহ যেন সরকারি খাজাঞ্চিখানার দরজাটি 'চিচিং ফাঁক' বলিয়া খুলিয়া ফেলিয়াছে, যে দরজা জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা, জনাহারের জন্য বিগত ১০ বৎসরে কখনো খুলিয়াছে বলিয়া কেহ স্মরণ করিতে পারিতেছেন না। সরকারি হিসাব প্রকাশিত হইয়াছে, এই বৎসর বাংলার প্রায় ৪০ হাজার দুর্গাপূজা সমিতি প্রত্যেকে ৬০ হাজার টাকা করিয়া পাইবেন নিজেদের উদ্যোগে বারোয়ারী দুর্গাপূজা করিবার জন্য। জনান্তিকে অবশ্য শুনিতে পাওয়া যাইতেছে যে উক্ত সহায়তার থেকে ২৫ হাজার টাকা নাকি শাসক দলের প্রতিভূ, স্থানীয় বিধায়কের কাছে উপহার স্বরূপ দিতে হইবে। সে যাহাই হউক, স্বাধীনপPP ভারতবর্ষে, অদ্যবধি এই রাজ্যের কোন সরকারই এইরূপ বিচক্ষণতা দেখাইতে পারে নাই। রাজ্যের আপামর মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের থেকে সংগৃহীত রাজস্বের অর্থ এইভাবে একটি বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজনে যে হরির লুঠের মত ছড়াইয়া দেওয়া যাইতে পারে, অদ্যবধি এ রাজ্যের কোন মুখ্যমন্ত্রীই তাহা ভাবিয়া উঠিতে পারেন নাই। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এ বিষয়ে তাহার সমসাময়িক সমস্ত রাজনীতিবিদদেরই ছাড়াইয়া আগাইয়া গিয়াছেন। সম্ভবত উত্তরপ্রদেশের অধুনা মুখ্যমন্ত্রীই তাহাকে কেবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে সক্ষম। সাধারণ মানুষের থেকে সংগৃহীত রাজস্বের অর্থে এ রাজ্যের মাননীয়া কেবল পূজা সমিতিগুলিকে আর্থিক অনুদানই নয়, তাহাদের পূজা নামক মোচ্ছবটি চালাইবার জন্য বিদ্যুতের খরচ ৬০% অবধি মকুবের বন্দোবস্ত করিয়াছেন, এমনকি তাহাদের স্ব স্ব পুরসভায় দেয় রাজস্বও মকুব করিবার ঘোষণা করিয়াছেন। এই বৃহৎ দানকর্মে রাজ্য সরকারের ন্যূনতম ২৪০ কোটি টাকা ব্যয় হইবে। এ ব্যতীত অন্যান্য সুবিধা দিবার জন্য বিদ্যুৎ সংস্থা ও পুরসভার যে আর্থিক দায়ভার চাপিবে ভবিষ্যতে তাহা এ রাজ্যের বলহীন প্রজার ঘাড় ভাঙিয়াই যে আদায় হইবে একথা একজন নাবালকও বুঝিতে পারিতেছে।

অবশ্য এ রাজ্যের সরকার পোষিত বুদ্ধিজীবী ও স্বঘোষিত শাসক দলের শুভাকাঙ্খী ও তথাকথিত ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাগ্রত বিবেকবান মানুষেরা বলিবেন যে সরকারের এই কর্মে এত গেল গেল রব উঠিবার কী আছে। হাড় হাভাতে বাঙালির সম্বৎসরের একটিমাত্র উৎসব যাহা ঘিরিয়া বিরাট পরিমাণ অর্থের লেনদেন হইয়া থাকে, উচ্চবিত্ত হইতে প্রান্তজন অবধি বৎসরের এই সময়টুকুতে একটুখানি অধিক উপার্জন করিতে পারে। ফলে এই উৎসবে সরকারি কোষাগার উম্মুক্ত হইলে তাহাতে খারাপ কী? রাজ্যের অর্থনীতি আরও গতি পাইবে, রাজ্যের অভুক্ত জনতা হইহই করিয়া দারিদ্যসীমা ভাঙিয়া উন্নয়নের অংশীদার হইবে। তাহাদের একথা যদিও কেহ জিজ্ঞাসা করিতেছেন না যে সরকারি কোষাগারের এই অর্থ তো পাইবে সমিতি, সেই উৎসব ঘিরে যে ব্যবসায়িক কর্মকান্ড, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তারা তো কোন সরকারি অনুদানের ভাগীদার হইতেছেন না। এযাবৎ তো সরকারি অনুদান ব্যতিরেকেই এই উৎসব ও তাহাকে ঘিরিয়া অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ভালোই চলিতেছিল। উপরি, কলিকাতার অধিকাংশ বৃহৎ পূজাগুলির আনুমানিক খরচ এই সরকারি অনুদানের বহুগুণ বেশী। তাহাদের আয়োজন আদৌ এই অনুদানের মুখাপেক্ষী নহে। বরং অধুনা রাজ্যের শাসকগোষ্ঠীর একাধিক ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা (যাহাদের ব্যক্তিগত বিত্ত অনেককেই লজ্জা দিবে) এই সমস্ত পূজার উদ্যোক্তা এবং এতকাল তাহারা বিনা কার্পণ্যেই পূজাগুলি চালাইয়া আসিতেছেন। তাহা হইলে তেলা মাথায় তেল ঢালিবার এই উদ্যোগ কেন? যে রাজ্য সরকার প্রাত্যহিক নুন আনিতে পান্তা ফুরাইবার কাঁদুনি গাহিতেছেন তাদের কি এইরূপ বেহিসাবি হওয়া সাজে?

টানাটানির সংসারে অপচয় কেহই করেনা। সুতরাং পূজা সমিতিকে এই অনুদানও শাসক দলের নিকট অপচয় নহে। আদতে ওনারা পরবর্তী নির্বাচনের লাভ লোকসানের হিসাব কষিতেছেন, যে হিসাবে রাজ্যের গরীব জনতার কোন স্থান নাই। আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত এই সরকার বাহুবলের ভরসায় ও সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় আবেগে ভর করিয়া আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হইবার স্বপ্ন দেখিতেছেন। একাধারে স্থানীয় সমিতিগুলিকে আর্থিক অনুদান দিয়া প্রলুব্ধ করা ও নিজেদের আজ্ঞাবহ করে তোলা এবং অন্যদিকে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপি নামক ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী দলটির সাথে এক প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক তুষ্টিকরণের চেষ্টা। এই দুই উদ্দেশ্য থেকেই সরকারি কোষাগার এভাবে সাংবিধানিক দায় দায়িত্ব অস্বীকার করিয়া ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অনুদানের জন্য খুলিয়া দেওয়া হইয়াছে। ইহা কেবল এরাজ্যের অসাম্প্রদায়িক জনগণের সহিত বিশ্বাসঘাতকতাই নহে, বরং কালিদাসের মতন নিজের পায়ের উপরেই কুঠারাঘাত।

প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতায় কেন্দ্রের দলটি যে ধারে ও ভারে রাজ্যের শাসক দলের তুলনায় অনেক প্রতাপশালী তা সকলেই বিলক্ষণ বোঝেন। সুতরাং মাননীয়ার এই উদ্যোগ কেবল আত্মঘাতী নহে, বরং এই রাজ্যে বিজেপির পথই সুগম করিবে। আর জনগণের সচেতন যে অংশ এইসব বুঝিয়াও মৌনব্রত অবলম্বন করিয়াছেন তাহাদের ফ্যাসিবাদের বিরোধিতার উৎসাহ নিয়াই প্রশ্ন জাগে। মাননীয়া হয়ত ভাবিতেছেন দুর্নীতির তদন্তের নাগপাশ যা ওনার গলায় চাপিয়া বসিয়াছে হয়ত আমোদ যজ্ঞের আয়োজন করিলে জনগণ তা ভুলিয়া যাইবে। তাই কেবল সরকারি কোষাগার উন্মুক্ত করেই ক্ষান্ত হননি, এক মাসব্যাপী এক মোচ্ছবের আয়োজনও উনি করিয়াছেন। বিদ্যালয় থেকে ছাত্র-ছাত্রী সহ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের, স্বনির্ভর গোষ্ঠিগুলিকে ও অন্যান্য সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত সংস্থাকে বাধ্য করা হইতেছে এই মহামোচ্ছবের উদ্বোধনে অংশগ্রহণ করিতে। গোটা রাজ্য জুড়িয়া এক আমোদযজ্ঞের আয়োজন চলিতেছে দুর্নীতির পাপ ঢাকিতে। জনগণ এই তামাশায় নিজেদের দায়িত্ব বিস্মৃত হইবে কিনা তাহা সময়ই বলিবে, তবে আশঙ্কা জাগে। যেভাবে তাঁরা নির্বিবাদে তাঁহাদের রাজস্বের এই অপচয় মুখ বুজিয়া মানিয়া লইতেছেন তাহাতে সংশয় জাগে এ কেবল দুরাচারী শাসকেরই ছল নাকি বঙ্গের জনগণের মনোগত চাহিদা?

সমালোচনার পাশে একথাও স্মরণ করাইয়া দেওয়া প্রয়োজন এই পরিমাণ অর্থে এ রাজ্যে জনহিতে কী কী কার্য সম্পন্ন হইতে পারে। সরকারি হিসাবেই আর্থিক খরচ হইবে ২৬০ কোটি টাকার মত। এই অর্থে এ রাজ্যে সরকারি বিদ্যালয়গুলির কিয়ৎ পরিমাণ সংস্কার হইত, রাজ্য সরকারের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্বৎসরের ব্যয়ভার বহন হইত। এ রাজ্যে সরকারি হাসপাতালগুলিতে নিয়োগ করা সম্ভব হইত, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির সংস্কার করা সম্ভবপর হইত। সরকারি পরিসংখ্যানমতে সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে বর্তমানে মিড ডে মিলের বরাদ্দ দৈনিক ৮ টাকা, যা বৃদ্ধি করা যাইত এই অর্থে। যে রাজ্যে শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ পেটে ক্ষুধা লইয়া প্রত্যহ ঘুমাইতে যান, এই অর্থে তাদের অন্তত এক বৎসরের খোরাকির ব্যবস্থা করা চলিত। এহেন বহুবিধ কর্মকান্ড এই অর্থে করা সম্ভবপর যাহাকে কল্যানখাতে খরচ বলিয়া ধরা চলে। বরং তার বিপরীতে সরকারি অর্থে যে তামাশার আয়োজন চলিতেছে তাকে জনকল্যাণ বলিয়া কুতর্ক করা চলে, কিন্তু তাহা বিশ্বাসযোগ্য হয়না। অবিলম্বে এই প্রবণতার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ হওয়া দরকার। রাজ্যের জনগণকেও ইহা বুঝিতে হইবে, রাজনীতিবিদেরা তাহাদের ভেতর থেকেই উঠিয়া আসেন। ফলে আপামর জনতা যদি এই তামাশার বিরুদ্ধে স্বর না তোলেন তাহা হইলে কোন অবতার আসিয়া তাহাদের হইয়া এই লড়াই করিবেন না। এই তামাশার পুনরাবৃত্তি চলিতেই থাকিবে ও এভাবেই বারবার তাহাদের অর্থ লুঠ হইবে।