আরেক রকম ● দশম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২২ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

কয়েক টুকরো অসংলগ্ন লেখা

অমিয় দেব


১। কথার জন্ম?

‘ডিম নিরামিশ’ কথাটা কি পাঠক শুনেছেন? তবে ‘এগ (বা ‘ওভো’) - ভেজিটারিয়ান’ কথাটা হয়তো তাঁর অচেনা নয়। আছেন কেউ কেউ যাঁরা নিরামিশাষী, কিন্তু ডিম খান। খান, যেহেতু ডিম কোনও জ্যান্ত প্রাণী নয়। একটি বছর তিনেকের শিশুর কথা জানি যে আমিষ ভালোবাসে। তার এক পিসিদিদার কাছে সে মাঝে মাঝেই নালিশ করে, আজ বাড়িতে নিরামিষ রান্না। ওর খেতে ইচ্ছে করছে না। একটু মাছ-মাংস - নইলে অন্তত একটু ডিম তো করবে? তা নয়, খালি শাকসবজি! একদিন নিরামিষই হয়েছে, কিন্তু ওকে সঙ্গে একটা ডিম দেওয়া হয়েছে। পিসিদিদাকে জানাল, আজ ডিম নিরামিষ। নিশ্চয়ই বলতে চেয়েছে, পাতে ওর নিরামিষই, তবে সঙ্গে একটা ডিমও আছে। ‘ডিম’ ও ‘নিরামিষ’ শব্দ দুটোকে পাশাপাশি নিয়ে এলে যে একটা কথার জন্মও হয়ে যেতে পারে, তার বোধ নিশ্চয়ই ওর নেই। আর ওর এইটুকু জীবনে কারও কাছে আগে কথাটা শুনেছে বলেও মনে হয় না। বস্তুত, কেউই কি আমরা আগে খুব শুনেছি? অন্তত আমি তো শুনিনি, আমার উননব্বইতেও না। অথচ নিরামিশ হিসেবে যে ডিম খাওয়া যায়, সে-ব্যাপারটা তো বেশ ধরা পড়ছে এতে। বাংলায় ‘এগ-ভেজিটারিয়ান’ না বলে দিব্যি ‘ডিম-নিরামিষ’ বলা যেতে পারে।

কোনও কথার কীভাবে জন্ম হয় তা বলা মুশকিল। বা কোনও শব্দের কখন অর্থব্যাপ্তি ঘটে। ‘না’ সহ ‘একদম’ খুব চেনা। অর্থ বোধ করি ‘একেবারেই’। কিন্তু ‘না’ বাদ দিয়ে ‘একদম’ খুব শুনছি এখন। ভেতরে যেন একটা ‘হ্যাঁ’ ঢুকে বসে আছে। বুঝি-বা ‘একেবারেই তা’ বা ‘অবশ্যই’ অর্থে ‘একদম’। আমার রক্ষণশীল জিভে কি একটু ঠেকে? জানি না। তবে ইংরেজি ‘ডু গেট’ অর্থে ‘পান’ শব্দের যে-ব্যবহার এখন বাংলা বিজ্ঞাপনে দেখছি, তাতে সায় দেওয়া শক্ত। অবশ্য কারো মুখে এখনও শুনিনি। ‘পাওয়া’ ধাতুর যে-রূপ ‘পান’, তার মানে একেবারেই আলাদা। অধুনা যে-খিচুড়ি বাংলা আমাদের মাঝে মাঝেই গলাধঃকরণ করতে হচ্ছে তারই এক নিদর্শন ওই বিজ্ঞাপনী ‘পান’।

২। নজির

‘নজির’ না বলে ইংরেজি ‘প্রিসিডেন্ট’ বললে হয়তো কেউ কেউ আমরা তাড়াতাড়ি বুঝব। মানে, কোনও আগে হয়ে-যাওয়া ক্রিয়ার উদাহরণ। ধরো, এক বেঠিক কিছু তুমি করতে যাচ্ছ। আগে যে এমন বেঠিক কাজ হয়েছে তা তোমার মনে আছে। তার উপমা তুমি দিলে। আগে যদি হয়ে থাকতে পারে তবে এখন কেন হবে না? এইভাবে, বিধান সত্ত্বেও কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক তা নিয়ে ধন্দ তৈরি হতে পারে। সামাজিক কি রাষ্ট্রিক আপেক্ষিকতাই হয়তো তোমাকে দিয়ে একাজ করাচ্ছে। ফলে অতীত খুঁড়ে তুমি ভবিষ্যৎকে ভুলতে বসেছ। ভুলে যাচ্ছ যে ভাবী বেঠিকের তুমি ‘নজির’ হয়ে রইলে। অথচ নজির তো অন্যরকমও হতে পারে। ভাবো, যখন কোনও মামলা চলে আদালতে তখন কত নজির টানা হয়। উকিলকে যথাসম্ভব অতীত মামলার বিবরণ জানতে হয় - কোন মামলার কী রায় হয়েছিল তা নখাগ্রে রাখতে হয়। তাঁর চেম্বারে যাও, দেখবে তিনি তাকবোঝাই বিবরণমালা সাজিয়ে রেখেছেন। শুধু কানুন নয়, সমূহ মামলার বিবরণও তিনি নিয়মিত অধ্যয়ন করেন, যাতে যথাসময়ে ‘ধর্মাবতার’ বলে উঠে দাঁড়াতে পারেন। বলতে পারেন, ‘নজির’ আছে।

৩। সাহস

এই ২০ জুন গৌরকিশোর ঘোষের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপিত হল। নির্ভীক সাংবাদিক, তন্নিষ্ঠ লেখক, মানবতাবাদী গৌরকিশোর ঘোষ - তাঁর অভাব আজ তীব্র হয়ে বাজছে। আজ, যখন গণতন্ত্রের ফাঁকফোকর দিয়ে মাথা তুলছে স্বৈরাচার, যখন ধর্মদ্বেষ প্রকট হয়ে উঠছে দিনের পর দিন, যখন বিত্তের সব রশিই কতিপয় শিল্পপতির হাতে। আজ, যখন মতভেদ মানেই দেশদ্রোহ। (এখন প্রয়াত, প্রখ্যাত কন্নড় লেখক অনন্তমূর্তিকে তো গোড়ায় একবার পাকিস্তানের প্লেন-টিকেট পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।) অন্যায়ে চোখ বুঁজে থাকা মানেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া, বলতেন গৌরকিশোর ঘোষ। কিন্তু আমাদের সাহস কই? ইন্দিরা গান্ধীর ‘ইমার্জেন্সি’তে আমার বন্ধু, ‘কলকাতা’ সম্পাদক জ্যোতির্ময় দত্ত তাঁর পত্রিকার এক ‘রাজনীতি সংখ্যা’ বের করে, আর তাতে গৌরকিশোর ঘোষের অন্যত্র নিষিদ্ধ লেখা প্রকাশ করে যে-সাহস দেখিয়েছিলেন, তার ছিঁটেফোঁটাও তখন আমার ছিল না (যদিও বছর বারো পরে পাসপোর্টের ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’-এ আমাকে শুনতে হয়েছিল, ইমার্জেন্সিতে জ্যোতির্ময় দত্তর সঙ্গে কী সম্পর্ক ছিল?), এখনও নেই। তেমন সাহস থাকলে তো আমি এখন আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানকে খোলা চিঠি লিখতাম। ইতিহাস হয়ে ওঠা ‘আমাকে বলতে দাও’ কি আমাদের সেই সাহস একেবারেই জোগাবে না?

৪। চারিত্র

কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা যে সম্ভব তা অম্লান দত্তও দেখিয়ে গেছেন। তাঁরও ছিল, রবীন্দ্রনাথের অর্থেই, চারিত্র। এই ১৭ জুন, তাঁর নিরানব্বই বা প্রাকশতবর্ষ মাথায় রেখে, এক আলোচনাসভাও হয়ে গেল ‘জিজ্ঞাসা’ দপ্তরে। যেয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম তাঁর কথা কেন আমাদের এখন বলতে হবে। রাষ্ট্রনৈতিক বিপ্লবে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না, বিশ্বাসী ছিলেন সামাজিক বিপ্লবে। অহিংসায়। গান্ধীর গ্রামসমাজ আর রবীন্দ্রনাথের পল্লীমঙ্গল ছিল তাঁর আদর্শ। ‘গণতন্ত্রের স্বপক্ষে’ তথা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তিনি শুধু ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রচারই করেননি, সমাজযাত্রা ও জীবনযাপন নিয়ে ক্রমান্বয়ে ‘চিন্তা’ করে গেছেন। তিনি প্রথাসিদ্ধ দার্শনিক ছিলেন না, তবে চিন্তাই ছিল তাঁর ধর্ম। তার কিছু ফসল তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে মেদিনীপুরের ‘ঐক্য’ পত্রিকা ২০১০-এ ছেপে বের করেছিল। তাতে যুক্তি ও অধ্যাত্মভাবের এক সমন্বয় দেখা যায়। কাঠ যুক্তিবাদী তিনি ছিলেন না, প্রেমের মূল্য তিনি দিতেন। আর প্রেম মানে বিরহও। বুদ্ধের ‘দুঃখ’, গান্ধীর ‘অহিংসা’, রবীন্দ্রগানের গভীর গভীরতর বোধ তাঁকে প্রাণিত করত।

৫। ক্ষমতা

‘ক্ষমতা’ কথাটার একটা মানে শক্তি। ‘ক্ষমতায়ন’ যখন বলা হয় - যেমন ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ - তখন শক্তির কথাই মাথায় থাকে। আত্মনির্ভরতা অর্থে। রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মশক্তি’ থেকে কি খুব দূরে আছি আমরা? আবার ‘ক্ষমতা’ কথাটায় এক ধরণের বৈষয়িক, সামাজিক, ইহজাগতিক পেশিবহুলতাও বোঝায় যার দৌলতে সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্যের উপর প্রকাশ্যে বা বস্তুত প্রভুত্ব করে। মিশেল ফুকোর 'Pouvoir' যার ইংরেজি করা হয় 'Power', ‘ক্ষমতা’ সেই প্রভুত্ব অর্থেই। সমাজে এই ক্ষমতা বহুরূপী। বোধ করি দণ্ড বা বশবর্তীকরণের নানান প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করতে করতে ফুকো এই ‘সত্যে’ পৌঁছন। আমরা যারা পাঠশালায় বেত খেয়েছি তারা জানি খালি নামতায় বা বানানেই শোভমান নন গুরুমহাশয়, বেত্রেও। লঘু-গুরু সদৃশ ভেদ যেখানেই আছে সেখানেই শঙ্কা প্রভুত্বের। লিঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়।


কৃতজ্ঞতাঃ দেবী বসু রায়