আরেক রকম ● দশম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২২ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৯

প্রবন্ধ

“কারা মোর ঘর ভেঙেছে স্মরণ আছে”

রঞ্জন রায়


যে কথাটা বলতে চাইছি তাতে “ঘর ভাঙছে” কথাটা বোধহয় সুপ্রযুক্ত হবে না। বলা উচিত “বাড়ি ভাঙছে”।

কোথায় ভাঙছে?

বাড়ি ভাঙছে যমুনার তীরে, ভাঙছে দিল্লির জাহাঙ্গীরপুরী মহল্লায়। আগে বাড়ি ভেঙেছে ইউপির কানপুরে, সাহারানপুরে এবং এলাহাবাদ, থুড়ি প্রয়াগরাজে।

কারা ভাঙছে? কেন সরকার ভাঙছে। কোন সরকার? রাজ্য সরকার। গুছিয়ে বললে রাজ্যের অধীন ছোট সরকার বা মিউনিসিপ্যালিটির আমলারা। আদেশ কে দিচ্ছে? আদালত? না না, সিটি ম্যাজিস্ট্রেট বা মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার।

কী দিয়ে ভাঙছে? গাঁইতি-কোদাল? ধ্যেৎ, এখন উন্নত যন্ত্রের দিন, বুলডোজার - বুলডোজারে।

ছোটবেলায় ভূত তাড়ানোর একটা মন্ত্র শুনতাম - কার আজ্ঞে? হাড়িপ বাবার আজ্ঞে। তাতে নাকি ভূত ছেড়ে যায়। এখন শোনা যাচ্ছে - যোগী বাবার আজ্ঞে।

উনিই শুরু করেছিলেন, যারা রাষ্ট্রের সম্পত্তি নষ্ট করবে, রাজ্যে শান্তি নষ্ট করবে এবং তার জন্যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে তাদের কাউকে ছাড়া হবে না। তাদের শায়েস্তা করতে বুলডোজার দিয়ে বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।

একেই বলে জিরো টলারেন্স! হাতে গরম শাস্তি।

এসব চলছে ২০১৯ সালে সেই শাহীনবাগ আন্দোলনের সময় থেকে। যখন থেকে বিনা বিচারে কথিত সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করার অপরাধে রিকশাওয়ালা থেকে আরও অনেককেই বারো হাজার থেকে লাখ টাকা অব্দি ফাইন দিতে হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে। পরে আদালত এগুলো বে-আইনি বলে রায় দিলেও বুলডোজারের জোশ কমেছে বলে মনে হয় না।

উনি ক’মাস আগেও নির্বাচনী সভায় বুলডোজার দাঁড় করিয়ে রাখতেন এবং বলতেন কিছু বুলডোজার সারাতে গেছে। ১০ই মার্চ ভোটের ফল বেরোক, তারপর মজা দেখবে।

এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে ওঁর নতুন নাম হল - বুলডোজার বাবা! উনি খুশি।

এখন উনি প্রচণ্ড বহুমতের জোরে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তারপর থেকে বুলডোজার চলছে একের পর এক। চটপট বিচার, চটপট শাস্তি। লোকজন খুশি। কে খামোকা আদালতে যায়! সেখানে গেলে কবে ফয়সালা হবে তা তো কেউ জানে না। যেটা জানে সেটা হল - তারিখ পে তারিখ! তারিখ পে তারিখ!

যখন হায়দ্রাবাদের পুলিশ চার জন নাবালিকা ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে ধৃত বন্দীদের পথে গাড়ি থেকে নামিয়ে গুলি করে মারল তখন আমরা অনেকেই একইভাবে উল্লসিত হয়েছিলাম। হাতে গরম জাস্টিস!

ওনার দেখানো পথে চলতে অনেকে সরকারই উৎসাহিত হবেন। সময় কম, খরচা কম।

যেমন হয়েছেন মধ্যপ্রদেশের গৃহমন্ত্রী, যেমন কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী।

কিন্তু কোথাও যেন একটা কাঁটা খচখচ করছে।

এই যদি সুশাসন হয়, যাতে আইন আদালতের দরকার নেই - সোজা কথায় পুলিশ যাকে চায় তাকে শাস্তি দিতে পারবে, তাহলে আইনের শাসন কাকে বলব? আর কাকেই বা বলি প্রাকৃতিক ন্যায় বা ন্যাচারাল জাস্টিস?

ন্যাচারাল জাস্টিস

দেখুন, আমরা বলি আইনের চোখে সবাই সমান - রাজা হোক অথবা প্রজা। তাহলে এর প্রয়োগ হবে কীভাবে? কী করে পক্ষপাতিত্ব বা প্রেজুডিস এড়িয়ে নিরপেক্ষ বিচার হওয়া সুনিশ্চিত করা যাবে? এর কোনো অন্তর্নিহিত ক্রস চেক সম্ভব কি? হ্যাঁ, খানিকটা সম্ভব, প্রাকৃতিক ন্যায়ের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে।

প্রাকৃতিক ন্যায়ের ধারণা মূলতঃ দুটো নীতির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এক, কেউ নিজে নিজের অভিযোগের বিচার করতে পারে না। নইলে পূর্বাগ্রহ বা বায়াসের সম্ভাবনা। অর্থাৎ পুলিশেরও ভুল হতে পারে। সে যাকে চোর বা খুনি ভাবছে তেমনটা নাও হতে পারে।

সেই জন্যেই বিচারবিভাগ এবং প্রশাসন বা তার পুলিশের মধ্যে ভাসুর-ভাদ্রবৌ সম্পর্ক বজায় রেখে চলার নিয়ম। কোনো অপরাধের অভিযোগ পেলে পুলিশ তদন্ত করবে, প্রমাণ জোগাড় করবে। কিন্তু শাস্তি দেবে আদালত, পুলিশ বা মন্ত্রী-শান্ত্রী নয়।

শাস্তির ভার আদালতের। পুলিশের কাজ বিচারকের সামনে এমন প্রমাণ পেশ করা যাতে অপরাধী শাস্তি পায়।

দুই, কাউকেই তার বক্তব্য না শুনে একতরফা শাস্তি দেওয়া যায় না।

এখন বুলডোজার বাবার রাজত্বে পুলিশ প্রশাসন অভিযোগ করছে। তারাই আদালতে দোষীকে পেশ না করে বুলডোজার চালিয়ে দিচ্ছে। মানে, তুমিই পুলিশ, তুমিই জজ, তুমিই জল্লাদ।

তাতে ন্যাচারাল জাস্টিসের প্রথম সিদ্ধান্তটি লঙ্ঘিত হচ্ছে।

আবার কথিত অবৈধ নির্মাণ ভাঙার ব্যাপারে কাউকে আপীলের জন্যে আইন দ্বারা নির্ধারিত ৩০ দিন সময় দেওয়া হচ্ছে না। এতে দ্বিতীয় সূত্রটি মার খাচ্ছে।

এছাড়া রয়েছে আর একটি সিদ্ধান্ত। শাস্তির পরিমাণ অপরাধের গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বা সমান অনুপাতিক হতে হবে। অর্থাৎ মশা মারতে কামান দাগা চলবে না।

তাহলে কোনো উত্তেজিত ভীড় পুলিশের গায়ে ঢিল ছুঁড়লে বা বাসে আগুন দিলে স্রেফ সন্দেহের বশে তার বা তার বৌ অথবা মায়ের বাড়িটি ভেঙে দেওয়া যায় কি?

দেখা যাক উত্তরপ্রদেশে বাস্তবে কী ঘটেছে।

ইউপি মেঁ কাবা?

প্রয়াগরাজ এলাকায় বাড়ি ভাঙাঃ

● এলাহাবাদ বা প্রয়াগরাজ শহরের করেলি এলাকায় ৩৯সি/২৪/১ নম্বর বাড়ির মালিক পরভীন ফাতিমা। তিনি জমি এবং বাড়িটি পেয়েছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে, প্রায় দু’দশক আগে। ব্যবসায়ী পরিবারের বাড়িটি এই দুই দশকে এক এক তলা করে আজ চারতলা। এতবছর ধরে তাঁরা নিয়মিত সম্পত্তি কর, বিজলি কর এবং জল কর দিয়ে আসছেন। ৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২-এর রসিদ অনুযায়ী পরভীন ফাতিমা এবছর ৪,৫৭৮ টাকার জল কর দিয়েছেন। কখনও কেউ বলেনি যে তাঁর বাড়ি কোথাও এনক্রোচমেন্ট করেছে বা কোন অংশ অবৈধভাবে নির্মিত।

হ্যাঁ, সমস্ত কাগজপত্র এবং রসিদ পরভীন ফাতিমার নামে। কিন্তু গত ১১ জুন তারিখে তাঁর স্বামী, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক কর্মী জাভেদ মহম্মদকে ১০ তারিখের বিজেপি মুখপাত্র নুপূর শর্মার উস্কানিমূলক মন্তব্যের প্রতিবাদে মিছিল সংগঠিত করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হল। তারপর জাভেদের নামে ‘অবৈধ নির্মাণের’ নোটিস দিয়ে এক রাতের মধ্যে বাড়ি খালি করতে বলে পরের দিন পারভীনের বাড়িটি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হল। মিউনিসিপ্যাল অথরিটি বললেন, সব নিয়ম মেনে নোটিস দিয়ে তবেই হয়েছে।

● সরকারের বক্তব্য, নেমপ্লেটে লেখা আছে ‘জাভেদ এম’ - পারভীনের স্বামী জাভেদ মহম্মদের নাম। পাঁচিলের উপর একটা সাইনবোর্ড, তাতে লেখা “ওয়েলফেয়ার পার্টি অফ ইণ্ডিয়া”, জাভেদের তৈরি দল।

● গত ১০ জুন বিজেপি’র মুখপাত্রের বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে এলাহাবাদে উগ্র বিক্ষোভ হয়। প্রয়াগরাজ ডেভেলপমেন্ট অথরিটি ১১ই জুন রাত্রিতে নোটিশ জারি করে জাভেদকে বলে যে কাল সকালের মধ্যে বাড়ি খালি করে চলে যাও। তার পরের দিন সকালে পুলিশ নিয়ে এসে বুলডোজার দিয়ে বাড়িটি ভেঙে দেয়।

● সরকার হাইকোর্ট ও সুপ্রীম কোর্টে হলফনামা দিয়ে বলে যে বাড়ি ভাঙার পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। আসলে মে মাসে স্থানীয় তিন জন লোকের কমপ্লেন এসেছিল যে, এই বাড়িতে অবৈধ নির্মাণ ও জমিতে এনক্রোচমেন্ট হয়েছে। এছাড়া এখানে বিনা অনুমতিতে একটি রাজনৈতিক দলের অফিস খোলা হয়েছে। তাই ইউপি আর্বান প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর ধারা ২৭(১) অনুযায়ী শো কজ নোটিস দিয়ে গত ২৪ মে সকাল ১১টার মধ্যে অফিসে এসে নিজের বক্তব্য রাখতে বলা হয়েছিল। কেউ আসেনি। তাই ভেঙে ফেলার আদেশ দেওয়া হয়েছিল।

● জাভেদের আইনজীবি কে. কে. রায় বলেন যে, মুসলিম ল’ অনুযায়ী স্ত্রীর সম্পত্তিতে স্বামীর কোন অধিকার নেই। এ বাড়ির সম্পত্তি কর, বিজলি বিল এবং জল কর সবকিছু জমা হয় স্ত্রী ফাতিমার নামে। তাহলে কেন জাভেদের নামে শো কজ দিয়ে বাড়ি ভেঙে ফেলা হবে?

দুই, কথিত একই অভিযোগের কপি হাইকোর্ট ও সুপ্রীম কোর্টে সরকার জমা দিয়েছে। তাতে উচ্চ আদালতের কপির ভাষা হিন্দি, সর্বোচ্চ আদালতের কপিতে দেখা যাচ্ছে অভিযোগ ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল!

তিন, এলাহাবাদ হাইকোর্ট গত বছর তার আদেশে বলেছে যে, ভেঙে ফেলার আদেশ পাশ করার পরও আইন অনুযায়ী অভিযুক্তদের আপীল করার জন্যে ৩০ দিন সময় দিতে হবে। সেটা না দিয়ে ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে কেন ভেঙে ফেলা হল? মামলাটি বিচারাধীন।

কানপুর ডেভেলপমেন্ট অথরিটি-ও (কেডিএ) কম যায় না। হায়াত হাশমি বলে ছেলেটি কানপুর শহরে ৩ জুনের হিংসায় লিপ্ত থাকার অভিযোগে ৪ তারিখে গ্রেফতার হল। কিন্তু ওর মা সঈদা জাফর নোটিস পেলেন যে, তুমি তোমার ২০০ বর্গ গজের জমিতে (১,৮০০ বর্গ ফুট) দুটো তলার বেশি নির্মাণ করে তাতে বিনা অনুমতিতে হোস্টেল চালাচ্ছ। ৩০ জুনের মধ্যে আমার অফিসে এসে জবাব দাও কেন তোমার হোস্টেলটা ভেঙে ফেলা হবে না।

দ্য কিউরিয়াস কেস অফ মহম্মদ ইশতিয়াক

হায়াত হাশমির উপর পুলিশের রাগ বোধহয় সহজে পড়েনি। তাই ১১ জুন তারিখে কানপুরের স্বরূপনগরে ভেঙে দেওয়া হল একটি কমার্শিয়াল বিল্ডিং যা নাকি পুলিশের ভাষায় ৩ জুন তারিখে ঘটে যাওয়া হিংসার পেছনে আসল মাথা হায়াত হাশমির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের।

কিন্তু কানপুর ডেভেলপমেন্ট অথরিটির বক্তব্য - ওসব কিছু নয়। এটা ল্যান্ড মাফিয়ার বিরুদ্ধে রুটিন অভিযানের অঙ্গ। বাড়িটির মালিক ইশতিয়াকের ল্যান্ড মাফিয়ার সঙ্গে যোগ আছে। ওসবখুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে।

ইশতিয়াকের ৪৫ বছরের ছেলে ইফতেকার আহামেদ পেশায় দর্জি। ওর বক্তব্য, বাড়িটা আমার বাবা ইশতিয়াকের (৭০) নামে ঠিকই, কিন্তু উনি তো গত ২০১৯ সালে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। আর আমরা কোনো দিনই হায়াত হাশমি বলে কারও আত্মীয় নই। আমি কোনো বিক্ষোভ প্রদর্শনে অংশগ্রহণ করিনি।

তাহলে কেডিএ যে বলছে বিনা অনুমতিতে অতিরিক্ত নির্মাণের অপরাধ? দেখুন, আমাদের বড়িটায় দুটো অতিরিক্ত তলা বানাচ্ছিলাম কমার্শিয়াল বিল্ডিং করব বলে। যদি অবৈধ নির্মাণ হচ্ছিল তো ভাঙার আগে বলে দিলেই পারত। কোনো নোটিস দেয়নি।

কেডিএ’র বক্তব্য, যদ্দূর জানি নোটিস দিয়ে শুনানিতে ডাকা হয়েছিল, আসেনি। সেজন্যেই ভাঙার আদেশ দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু আদেশের পর যে ৩০ দিন আপীল করার ম্যান্ডেটরি ধারা?

কিন্তু ইউপি সরকার তো বলছে যে তাঁরা নির্দিষ্ট আইন মেনেই অবৈধ নির্মাণ ভাঙছেন, খেয়ালখুশি মতো নয়।

তাহলে সেই আইনগুলো কী বলে একটু দেখা যাক।

ইউপি আরবান প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৭৩ এবং ইউপি রেগুলেশন অফ বিল্ডিং অপারেশন অ্যাক্ট, ১৯৫৮ তথা এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়।

উপরের দুটো আইন মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষকে কারও বাড়ি ভাঙার অধিকার দেয়, যদি সেই বাড়ি নগর উন্নয়নের মাস্টার প্ল্যানের নকশা না মেনে বা কর্তৃপক্ষের আবশ্যক অনুমতি না নিয়ে তৈরি হয়ে থাকে।

আবার উক্ত ১৯৭৩ আইনের সেকশন ২৭(২) বলছে, সেকশন ২৭(১) অনুযায়ী ভাঙার অর্ডার পাওয়া ব্যক্তির চেয়ারম্যানের কাছে আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করার জন্যে ৩০ দিন সময় দিতে হবে। আপীল শুনে চেয়ারম্যান চাইলে আদেশ আংশিক বা পুরোপুরি বদলে দিতে পারে। বা আপীলটাই খারিজ করে ভাঙার অর্ডার কায়েম রাখতে পারে।

অর্থাৎ, বাস্তবিক ভেঙে ফেলার আগে অর্ডার পাশ করার পরও আইন মোতাবেক বাড়ির মালিককে আপীল করার জন্যে ৩০ দিন সময় দিতে হবে। সেই আপীল না শোনা পর্যন্ত মিউনিসিপাল অথরিটিকে অপেক্ষা করতে হবে। এটাই ছিল ২০২০ সালের অক্টোবরে আব্বাস আন্সারি বনাম ইউপি সরকার কেসে এলাহাবাদ হাইকোর্টের জাস্টিস শশীকান্ত গুপ্তা এবং জাস্টিস পঙ্কজ ভাটিয়া’র রুলিং।

ওই হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি গোবিন্দ মাথুর একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে ইউপি সরকার জাভেদ মুহম্মদের বাড়ি ভাঙার ক্ষেত্রে এলাহাবাদ হাইকোর্টের ২০২০ সালের রুলিং অমান্য করেছে। কারণ ৩০ দিন আপীলের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা না করে একদিনের নোটিসে বুলডোজার চালিয়ে দিয়েছে।

আব্বাস কেসে ওই রুলিং দেওয়ার সময় বিচারপতিদ্বয় মন্তব্য করেছিলেনঃ বেশ কয়েকটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যে, ইউপি সরকার বাড়ির মালিকদের আপিলের সময় না দিয়েই সেগুলো ভেঙে ফেলছে। তাই আমরা গোটা ইউপি রাজ্যের জন্যে ‘জেনারেল ম্যান্ডামাস’ (সরকারকে নির্দেশ) জারি করছি যে ওই দুটো আইনের অধীনে কোনো বাড়ি ভাঙার আদেশ দিলে তারপর অবশ্যই ৩০ দিন আপীলের সময় দিতে হবে।

ইউপি সরকার আব্বাস আনসারি কেসে হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে গেল। সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় ১২ই মার্চ, ২০২১ তারিখে সরকারের পিটিশন শুনানির জন্যে গ্রহণ করল, কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের উপর কোনো স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করল। আজ অবধি ও নিয়ে কোনো শুনানি হয়নি এবং এলাহাবাদ হাইকোর্ট ইতিমধ্যে ওই রুলিং অনুযায়ী তিনটে কেসে ভাঙার আদেশে অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ দিয়ে বলল আগে বাড়ির মালিকের আপিল শুনতে হবে।

কিন্তু ইউপি সরকারের ওসব ধর্মকথা শুনতে বয়েই গেছে।

ওরা এ’বছর জুন মাসে জাভেদ মহম্মদ কেসে ওকে জেলে পুরে একদিনের নোটিসে বাড়ি ভেঙে দিল। স্ত্রী এবং কন্যা হাইকোর্টে যাওয়ারও সময় পেল না।

রুল অফ ল বনাম রুল বাই ল

গত ১৫ই জুন জামাত-উলেমা-ই-হিন্দ সুপ্রীম কোর্টে এক আবেদন পেশ করে বলে যে, মাননীয় সর্বোচ্চ আদালত ইউপি সরকারকে কানপুর এবং অন্যান্য স্থানে কথিত একতরফা ভাবে ‘বেআইনি নির্মাণ’ লেবেল লাগিয়ে বাড়িঘর ভেঙে দেওয়ার প্ল্যানকে নিষিদ্ধ করুক।

প্রয়াগরাজে পুলিশ ৩৭ জন অভিযুক্তের প্রাথমিক সূচী ডেভেলপমেন্ট অথরিটিকে ধরিয়ে দিয়ে বলেছে পরীক্ষা করে দেখতে যে কোন কোন বাড়িতে ‘বেআইনি নির্মাণে’র অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে সেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে।

কানপুরের ঘটনার পর মিডিয়াতে বেশ কিছু লোকজন বলছেন যে, সন্দিগ্ধ অভিযুক্তদের বাড়ি ভেঙে ফেলা হবে।মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত দয়া করে ইউপি সরকারকে নির্দেশ দিলো যে আগ বাড়িয়ে কারও কোনো বাড়িঘর যেন দাঙ্গার অভিযোগে কথিত ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা' হিসেবে না ভাঙা হয়। এসব “এক্সট্রা লীগাল পিউনিটিভ মেজার”। আর ভবিষ্যতে কারও বাড়ি ভাঙার আগে যেন প্রাসঙ্গিক আইনের নির্দেশ মেনে, সময়মত আগাম নোটিস দিয়ে প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে তার পক্ষ শোনানোর সুযোগ দেওয়া হয়।

সুপ্রীম কোর্টে জাস্টিস বোপন্না এবং জাটিস নাথের বেঞ্চ ১৬ই জুন তারিখে জামাত-উলেমা-ই-হিন্দের উক্ত আবেদনে প্রাথমিক শুনানি করে বললঃ রুল অফ ল বা আইনের শাসন সবাইকে মানতে হবে। কোনো বাড়ি ‘ডিউপ্রসেস অফ ল’ না মেনে ভাঙা যাবে না। আবেদনে প্রয়াগরাজের জুবের মহম্মদ এবং কানপুরের আরও দুটো ঘটনার উল্লেখ ছিল।

তারপর ইউপি সরকারকে নোটিস দিয়ে ২১শে জুন নাগাদ জবাব দিতে বললেন। আরও বললেন, কোনো নির্দেশ জারি করা হয়নি, কিন্তু আশা করি এর মধ্যে কোন উল্টোপাল্টা কিছু ঘটবে না।

পিটিশনারদের উকিলেরা বলেন, এর আগেও কোর্ট কিছু নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু সেসব না মেনে আপীলের সুযোগ না দিয়ে বুলডোজার চলেছে। খেয়াল করার বিষয়, আগে কিছু লোককে সন্দেহের বশে আটক করা হচ্ছে। তারপর তাদের বিচার হওয়ার আগেই হয় তাদের, নয় তাদের মা বা স্ত্রীর বাড়ি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। অন্য অনেক বে-আইনি নির্মাণ সত্যিই আছে, সে নিয়ে কোন অ্যাকশন হচ্ছে না।

এবার কেন্দ্রীয় সরকার সঞ্চালিত দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির গল্পঃ

সরাই কালে খাঁ’র ঝোপড়িগুলো

● গত ৬ জুলাই তারিখে যমুনার তটবর্তী সরাই কালে খাঁ এলাকার গিয়াসপুর বস্তিতে দিল্লি ডেভলপমেন্ট অথরিটি (ডিডিএ) ঘর ভাঙা শুরু করে। যদিও দিল্লি হাইকোর্ট একটি আদেশে জুলাই ১১ পর্যন্ত ওখানে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ জারি করেছেন।

● আসলে গত ২৭শে জুন তারিখেই ২৩টি ঘর ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তখন ১১ জন ঝুপড়িবাসী হাইকোর্টে গিয়ে ডিডিএ-কে থামাতে আদেশ চেয়ে আবেদন করেছিল। ২৮শে জুন হাইকোর্ট বলে যে, ডকুমেন্ট দেখে মনে হয়েছে এঁরা সেই ১৯৯৫ সাল থেকেই এখানে আছেন। এবং এগুলো কোনো বিশাল বাড়ি নয় ঝুগগি-ঝোপড়ি মাত্র, যাতে গায়ে গায়ে ১০০র বেশি ঝুপড়ি আছে। অতএব, ১১ জুলাই পর্যন্ত যথাস্থিতি বজায় রাখা হোক।

● কিন্তু ডিডিএ বুলডোজার নিয়ে ৬ই জুলাই তারিখেই ওই ১১টা ঝুপড়িকে ছেড়ে বাকিগুলোকে গুঁড়িয়ে দেয়। এদের অনেকেরই ১৯৯৫ থেকে ওই ঠিকানায় ভোটার কার্ড রয়েছে। এরা বলছিলেন যে, আগে থেকে কোনো নোটিস না দিয়েই এটা করা হয়েছে। এঁরা চাইছিলেন দিল্লি বস্তি এবং ঝুগগি-ঝোপড়ি পুনর্বাসন অধিনিয়ম ২০১৫ অনুযায়ী এঁদের বিকল্প বাসস্থানের ব্যবস্থা করে তবে ভাঙা হোক।

আরেকটা কথা। ভারতের পেনাল কোড বা দণ্ডবিধিতে সবরকম অপরাধের জন্যে নির্ধারিত শাস্তির ফিরিস্তি রয়েছে। আদালতের বিচারকেরা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করলে অপরাধের গুরুত্ব দেখে সেই রুল বুক অনুযায়ী শাস্তির প্রকার ও পরিমাণ ঠিক করে রায় দেন।

কিন্তু কথায় কথায় বুলডোজার? বিনা বিচারে? সরকার কোনো আইনের উল্লেখ না করে যাকে দোষী মনে হয় তাকে এভাবে শাস্তি দিতে পারেন?

তাতে আইনের শাসন বা রুল অফ ল’ না হয়ে রুল বাই ল’ হয়ে যাবে না? অর্থাৎ আইনের অছিলায় অপছন্দের নাগরিককে শাস্তি দিয়ে বলা যে সবকিছু আইন মাফিক হচ্ছে। এটা তো পুলিশ স্টেটের লক্ষণ।

আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে,
অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো
”।

শেষ পাতে

এটা সবার চোখে লাগছে যে বুলডোজার বাবার রাজত্বে ‘কড়া প্রশাসন’, ‘জিরো টলারেন্স’ জাতীয় বুকনির আড়ালে যা হচ্ছে তা শুধু গুন্ডামী নয়, রাজনৈতিক বিরোধীদের এবং একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকজনের ঘরদোরে বুলডোজার চালানো হচ্ছে আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে, এমনকি হাইকোর্টের আদেশেরও পরোয়া না করে।

আইনের শাসন, ‘ডিউপ্রসেস অফ ল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে কথার কথা। রাষ্ট্রের দ্বারা নিজেদের আইনকেই কলা দেখিয়ে নির্মম দমন চালানোর এমন উদাহরণ যেন এমার্জেন্সির সময় আজমেরি গেটের ঘটনাগুলোকে মনে করাচ্ছে। এর কথিত সাফল্য উসকে দিচ্ছে আরও কিছু রাজ্য সরকারকে।

যদিও এই বর্বর বুলডোজার পলিসির সাংবিধানিক বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে - সুপ্রীম কোর্টে, এলাহাবাদ এবং মধ্যপ্রদেশের হাইকোর্টে, তবু সেসব এখনও সরকারকে নোটিস দেওয়া জবাব চাওয়া পর্যায়ে থমকে রয়েছে। ইতিমধ্যে বুলডোজার - চলছে, চলবে!


তথ্যসূত্রঃ

১) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১ জুলাই, ২০২২।
২) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৪ জুন, ২০২২।
৩) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
৪) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১২ জুন, ২০২২।
৫) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৭ জুন, ২০২২।
৬) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৬ জুন, ২০২২।
৭) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৭ জুলাই, ২০২২।