আরেক রকম ● দশম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২২ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৯

সমসাময়িক

স্বর্গের নীচে মানুষ


বিখ্যাত সাহিত্যিক কিরণ নাগরকরের একটি উপন্যাসের নাম ‘গড’স লিটিল সোলজার’, অর্থাৎ ঈশ্বরের ছোট্ট সৈনিক। এই নভেলে নাগরকর একজন বিশুদ্ধ মৌলবাদীর মনস্তত্বের বিশ্লেষণ করেছেন, যে যখন ইসলামের সান্নিধ্যে আসছে তখন সে সালমান রুশদীকে হত্যা করার চক্রান্ত করছে, যে খৃষ্টধর্মের সান্নিধ্যে এসে খৃষ্টান মৌলবাদীর ভূমিকায় অবতীর্ণ, আবার হিন্দু হয়ে সে হিন্দু মৌলবাদী চিন্তাধারাকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করছে। তার সত্ত্বা একটাই - একটি চূড়ান্ত অসহিষ্ণু এবং মৌলবাদী সত্ত্বা যা বিভিন্ন সময় ভিন্ন ধর্মের জামা পরে সেই মৌলবাদকেই পুষ্ট করছে।

সালমান রুশদীকে নাগরকর বর্ণিত চরিত্র হত্যা করতে গিয়েছিল কিন্তু করতে পারেনি। কিন্তু বাস্তবে অবশেষে মৌলবাদ রুশদীকে আঘাত করতে সক্ষম হল। নিউ ইয়র্কে এক আলোচনা চলাকালীন ২৪ বছর বয়সী হাদি মাতার রুশদীর উপর ভয়ঙ্কর হামলা চালায়, বারবার ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয় রুশদীকে। আপাতত তাঁকে ভেন্টিলেটর থেকে বার করে আনা গেছে, কিছুটা চিন্তামুক্ত হওয়া গেছে। কিন্তু রুশদীর কী অপরাধ? ১৯৮৮ সালে তিনি একটি বই লেখেন যার নাম, ‘সাটানিক ভার্সেস’। এই বই প্রকাশিত হওয়ার আগেই ভারত সরকার একে নিষিদ্ধ করে এবং পরে বহু দেশে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। ইরানের আয়াতোল্লা খোমেইনি রুশদীকে হত্যা করার ফতোয়া দেন, যা এখনও বৈধ বলে অনেকে মনে করেন। এই ফতোয়ার পরে রুশদীকে বহু বছর নিভৃতবাসে থাকতে হয়। ইতিমধ্যে জাপানি ভাষায় ‘সাটানিক ভার্সেস’ যিনি তর্জমা করেন তাঁকেও অজ্ঞাত পরিচয় কিছু ব্যক্তি হত্যা করে। রুশদী কিছুদিন ধরে ভাবছিলেন যে এখন বোধহয় আর বিপদ নেই। ঠিক সেই সময় মঞ্চে উঠে ছুরি চালায় হাদি মাতার।

হাদি মাতার লেবানন বংশোদ্ভূত ২৪ বছরের যুবক, যার জন্মের ১১ বছর আগে ‘সাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশিত হয়। তবু কোনো এক অমোঘ টানে হাদি মাতারের মনে হয় রুশদীকে হত্যা করা তার কর্তব্য। আপাতত জানা গেছে যে, হাদি মাতার ইরানের শিয়াপন্থী উগ্র চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত। সরাসরি তাকে কেউ বা কারা হত্যা করতে বলেছে কি না, তা এখনও পরিষ্কার নয়। ইরান এই আক্রমণের থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে বিবৃতি দিয়েছে। তবু হাদি মাতার কোন অসীম টানে নিরপরাধ রুশদীর উপরে আক্রমণ চালিয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। উগ্র মৌলবাদী যে চিন্তাধারা নাগরকার তাঁর উপন্যাসে বলেছিলেন, সেই বিষাক্ত মনের শিকার হয়েই মাতার আক্রমণ করল রুশদীকে।

এই ঘটনা থেকে কয়েকটি কথা বলা যেতে পারে। প্রথমত, মৌলবাদী চিন্তা একবার সমাজে প্রসারিত হলে তা সুদূরপ্রসারী হয়। ৩৫-৪০ বছর পরেও আক্রমণ করা যায় তথাকথিত অন্যায়কারীকে। এই যে বহু বছর ধরে অনুরণন চলে একটি বিষাক্ত মানসিকতার তা শুধুমাত্র সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিজস্ব ক্রিয়ার ফলে হয় না, সমাজও এই চিন্তাধারাকে লালন করে চলে। দ্বিতীয়ত, একজন ব্যক্তি তিনি শুধু কলম চালিয়েছেন, তলোয়ার নয়। কাউকে হত্যা করেননি, কাউকে হত্যা করতে প্ররোচনা দেননি। কিন্তু শুধুমাত্র কোনো ধর্মীয় বেড়াকে অতিক্রম করেছেন বা তাকে অগ্রাহ্য করেছেন বলে তার মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করা যায়। অথচ, আধুনিকতার প্রাথমিক শর্তের মধ্যে যেই বাকস্বাধীনতার ধারণা প্রোথিত আছে তা অমান্য করা যায় এই একবিংশ শতাব্দীতেও। তাই রুশদীর উপরে নেমে আসে ছুরির আঘাত।

কিন্তু শুধু কি রুশদী? আমাদের দেশে একের পর এক হত্যা করা হয়েছে গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র ধাবোলকর, কৈলাশ কালবুর্গী, গৌরী লঙ্কেশের মতন লেখকদের। তাদের অপরাধ উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন তাঁরা। অতএব তাঁদের জন্য বরাদ্দ ছিল একেকটি বুলেট। হত্যাকারীরা এখনও ধরা পড়েনি। তদন্তে উঠে এসেছে হিন্দুত্ববাদী উগ্র সংগঠনের নাম। নাগরকারের উপন্যাসের খলনায়কের মতই এই উগ্রপন্থাও প্রাণঘাতী। ধর্ম পালটেছে শুধু, কিন্তু লেখকের জন্য বরাদ্দ শাস্তি একই আছে - বুলেট নয়তো ছুরি।

ঢাকার রাজীব রায়, নিউ ইয়র্কের রুশদী, ভারতের পানসারে-ধাবোলকর-কালবুর্গী-লঙ্কেশ মৌলবাদের শিকার। কোনো ধর্মের উগ্র সমর্থক বা মৌলবাদী মনে করেছেন যে তাঁর ঈশ্বরকে বাঁচানোর দায়িত্ব তাঁকে নিতে হবে, হয়ে উঠতে হবে ঈশ্বরের সৈনিক। এমন একটা দিনের জন্যই আপাতত লড়াই করতে হবে, অপেক্ষা করতে হবে যেদিন ঈশ্বরের নামে মানুষ খুন করাকে মানবতার নিকৃষ্টতম অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। যুগে যুগে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ধর্মীয় ভেদাভেদকে হাতিয়ার করে মানুষের উপর জুলুম চালিয়ে গেছে। তাই স্বর্গের জন্য উন্মত্ত মানুষের জন্য এই পৃথিবীকে আরো ভালো বসবাসযোগ্য করে তোলার লড়াই চালিয়ে যাওয়াই প্রগতিশীল রাজনীতির কর্তব্য হওয়া উচিত, যাতে মানুষ মৃত্যুর পর এক কাঙ্ক্ষিত স্বর্গ নয়, এই পৃথিবীতেই স্বর্গের স্বাদ পান। এই লড়াই দীর্ঘ তবু না লড়ে উপায় নেই।