আরেক রকম ● দশম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২২ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৯

সমসাময়িক

দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই


চড়াম চড়াম ঢাক দিব্যি বাজছিল রাঢ়ভূমের মাটিতে, উন্নয়ন রাজ্যের রাজধানী, জেলা অফিস মায় ব্লক অফিস পার করে একেবারে দোরগোড়ায় গিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল। গুড়-বাতাসার আপ্যায়নে অভিভূত জেলা থেকে রাজ্য প্রশাসন নিশ্চিন্ত নিদ্রায় ছিল যাতে উন্নয়নের কার্যক্রমে কোন বাধা না পড়ে। সেই উন্নয়ন দরিদ্র দেশবাসীর সুদিনের মত অদৃশ্য নয়, বরং তার সতেজ, সবল উপস্থিতি এমনই যে উন্নয়নের শাঁসে জলে কান্ডারি থেকে মায় তার দেহরক্ষী অবধি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মাপে দেশের ৯৫ ভাগ মানুষকে পেছনে ফেলে দিয়েছেন। হঠাৎ করেই সেই উন্নয়নের গতিতে বাধা পড়েছে। উন্নয়নের কান্ডারি, মাননীয়ার প্রিয় কেষ্ট, বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মন্ডল গরু পাচার করার মামলায় আপাতত সিবিআই-এর হাতে গ্রেফতার হয়ে শ্রীঘরে গেছে। খবরে প্রকাশ অনুব্রতের বিপুল সম্পত্তির হদিশ পাওয়া গেছে যা নামী, বেনামী, স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি মিলিয়ে কত তা হয়ত ধীরে ধীরে জানা যাবে। ২০১১ সালের আগে এক সামান্য মাছ বিক্রেতার এহেন উন্নতির রসায়নটি অবশ্য খুব গোপন নয়। এই ব্যক্তি কেবল যে গরু পাচারের মত বেআইনি কাজে যুক্ত তা নয়, বরং গোটা জেলা জুড়েই চলা সমস্ত অবৈধ কারবারের মূল খুঁটি যে ইনিই তা জেলার মানুষ জানেন। অবৈধ পাথর খাদান থেকে শুরু করে হেন কোন বেআইনি কাজ নেই যাতে এই অনুব্রত মন্ডলের বখরা নেই। এমনকি কিছুদিন আগে অবধি এই জেলার দেউচা পাঁচামি অঞ্চলের কয়লাখনির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে ভাঙতে দলীয় মস্তান বাহিনী থেকে শুরু করে জেলার পুলিশ প্রশাসনকে চালনা করেছে এই ব্যক্তি। জেলাজুড়ে একটি সংগঠিত লুঠতরাজ কায়েম করার মূল কারিগর যে এই অনুব্রত মন্ডল তা কারোরই অজানা নয়। গোটা দেশ দেখেছে তিনি পুলিশকে বোম মারার হুমকি দিচ্ছেন, পদস্থ পুলিশ আধিকারিককে শাসাচ্ছেন, ভোটকে নিয়মিত প্রহসনে পর্যবসিত করেছেন। কিন্তু রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, যাঁর অনুপ্রেরণায় চিড়িয়াখানায় সিংহ শাবকের জন্ম হয়, তিনি কেষ্টর সমস্ত অপরাধ ধৃতরাষ্ট্রের ন্যায় দেখেও দেখেননি।

রাজ্যের প্রচার মাধ্যমগুলিও এই আদ্যন্ত রাজনৈতিক দুষ্কৃতীকে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে কম কসরৎ করেনি। তাই বগটুই–এর গণহত্যা ঘটার পর যখন এই মাফিয়া নেতা মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে পুলিশকে কেস সাজানোর নিদান দেয়, রাজ্যের মিডিয়া তা প্রচার করে, মানুষের সাংবিধানিক অধিকারকে এই দুষ্কৃতী যখন বারেবারে হরণ করেছে এবং সেই কর্মকান্ডকে 'গুড়-বাতাসা', 'পাঁচন-বড়ি' এইসব বলে অভিহিত করেছে, রাজ্যের মিডিয়া তাকে কৌতুকের আবরণে প্রচার করে এইসব কর্মকান্ডকে একপ্রকার মান্যতা দিতে সাহায্য করেছে। এই অপরাধীর সমস্ত অপরাধের বিচার হওয়া অত্যন্ত জরুরী।

একথা বলাই বাহুল্য যে, এরকম রাজনৈতিক মাস্তানদের প্রতাপ রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে প্রশ্রয় ছাড়া গড়ে উঠতে পারেনা। একথা যারা বুঝেও না বোঝার ভান করছেন, বর্তমান রাজ্য রাজনীতিকে মাফিয়া ও তোলাবাজদের মৃগয়াক্ষেত্র বানানোর পেছনে তাদেরও অবদান আছে। সিবিআই বা ইডির রাজনৈতিক প্রয়োগ যে হয় তা অনস্বীকার্য নয়। বিজেপি-র আমলে সিবিআই বা ইডি বারংবার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মামলা রুজু করেছে, বিরোধীদের কন্ঠস্বর রোধ করার হাতিয়ার হিসেবে সিবিআই-ইডি যে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কংগ্রেস সভানেত্রী ও সম্পাদককে ইডি যেভাবে ডেকে ঘন্টার পর ঘণ্টা জেরা করছে, কংগ্রেসের সদর দপ্তরে ঢুকে যেভাবে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত তা সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু এদের বাড়ি থেকে না বিপুল পরিমাণ টাকা পাওয়া গেছে, না তো এরা জেরা এড়ানোর জন্য সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অসুস্থতার ভান করছেন, না তারা দশবার ডাকার পরেও নানান টালবাহানা করে হাজিরা না দিয়ে অবশেষে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ফলে এই ঘটনার সাথে রাজ্যের বিধায়ক, প্রাক্তন মন্ত্রী বা জেলা সভাপতির গ্রেফতার এক পংক্তিভুক্ত নয়। এদের বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ হিসাব বহির্ভূত টাকা উদ্ধার হচ্ছে। রাজ্যে সংঘটিত একাধিক দুর্নীতির সাথে এরা যুক্ত। এমনকি সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে সিবিআই বা ইডির অভিযোগের সারবত্তা আছে। অনুব্রত বা পার্থর বিরুদ্ধে আইনি ভাষায় যাকে বলে প্রাইমা-ফেসি এভিডেন্স রয়েছে, মানুষ তাদের দুর্নীতির সাক্ষী। এখন শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হচ্ছে বলে দুর্নীতিপরায়ণ নেতা, যারা জনগণের টাকা শুষে অট্টালিকা বানিয়েছে তাদের আড়াল করার চেষ্টা অন্যায়।

যদিও একথা ফেলে দেওয়ার মত নয় যে, তদন্তকারী সংস্থাগুলির তৎপরতা কতদূর বজায় থাকবে? কারণ অতীতে সারদা বা নারদ ঘুষ কাণ্ডে জড়িতরা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ বিজেপির ছত্রছায়ায় গিয়ে বেঁচেছে। বিশেষ করে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে নারদ কেলেঙ্কারীতে দেখা গেছে। অথচ, শুভেন্দু এখন বিজেপিতে বলে ইডি-সিবিআই তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা এখনও অবধি নেয়নি। এই দ্বিচারিতা মেনে নেওয়া যায় না। রাজনৈতিকভাবে সিবিআই-ইডিকে ব্যবহার না করে তাকে স্বাধীনভাবে চলতে দিতে হবে এবং দুর্নীতিগ্রস্থ নেতাদের জেলে ঢোকাতে হবে। এই দাবিকে কেন্দ্র করে রাস্তায় যদি গণআন্দোলনের চাপ না থাকে তাহলে এই অনুব্রত মন্ডল বা পার্থ চ্যাটার্জি কারুরই অপরাধের বিচার হবে না, শুভেন্দুর মতন নেতারাও রেয়াত পেয়ে যাবে। অন্তত তাই এখন রাজ্যে বামপন্থীদের এই আন্দোলনকে পাখির চোখ করে দিবারাত্র রাস্তায় থাকতে হবে, মানুষকে সংগঠিত করে আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে হবে।

একজন অনুব্রত মন্ডল বা একজন পার্থ চ্যাটার্জি নয়, এই তৃণমূল দলটার প্রায় পুরোটাই এই ধরনের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতাতে ভর্তি। তা না হলে এতকিছুর পরেও এই দলটার নেতারা মঞ্চ খাটিয়ে তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করছে তাদের পেটানোর জিগির তুলতে পারত না। দেশের মানুষ এই নেতাদের তোয়ালেতে মুড়ে টাকা নিতে দেখেছে, গ্রামের পর গ্রামে তোলাবাজি এবং মানুষের উপর অত্যাচার চালানো হয়েছে এই নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে। কিন্তু ক্ষমতার দম্ভ এদের এতটাই অন্ধ করে দিয়েছে যে তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষ পথে নামলে, তাদেরকে পাল্টা মারার কথা শাসকদলের নেতারা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলছেন। এই কথাগুলি বলার সাহস তারা পাচ্ছে সরাসরি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্য জনসভায় দাঁড়িয়ে অনুব্রত মণ্ডলের পক্ষে ভাষণ দিচ্ছেন, নিজের বাড়িতে সিবিআই আসতে পারে এই কথাও বলছেন। আসলে অনুব্রত দলের এমন একজন নেতা যার হাত ধরে দলের লক্ষ্মী এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দুই-ই বেড়েছে। তাই অনুব্রতের পক্ষ ছাড়তে দিদি নারাজ। কোনো ব্যক্তি দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার হলে অন্তত তাঁকে তাঁর পদ থেকে সরানো উচিত বলে যেই কথা এক সময় নেতারা মানতেন এখন তা তামাদি। আর সত্যিই তো, চুরির অভিযোগ উঠলেই যদি নেতাদের পদ থেকে সরাতে হয়, তাহলে তৃণমূলে আর খুব বেশি পদ বাকিও থাকবে না, এমনটাই অনেকের আশঙ্কা।

একদল বুদ্ধিজীবি অবশ্য রাজ্যে আছেন যারা তৃণমূলের মধ্যে নিম্নবর্গের উত্থান দেখেছিলেন। পার্থ-অর্পিতার মতন ‘নিম্ন বর্গের’ ব্রাহ্মণ সন্তানদের বাড়িতে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হওয়ার পরে এই বুদ্ধিজীবিদের দেখা পাওয়া যায়নি। কলকাতার রাস্তায় দুর্নীতিগ্রস্থদের শাস্তি চেয়ে কোনো মিছিল করতে দেখা যায়নি এই বুদ্ধিজীবিদের। আসলে কেবল নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থের জন্যই তারা আজ তৃণমূলের সমর্থক। কাল যখন হাওয়া পালটাবে, তখন তারা অন্য দলের দিকেই ঝুঁকবেন। আর যারা ভাবছেন, তৃণমূলের এইসব দুর্নীতি নিয়ে বেশি কথা হলে, রাজ্যে বিজেপির পথ সুগম হবে, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। একটি আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত দল কোনভাবেই বিজেপির মত একটি সংগঠিত ফ্যাসিস্ট দলের মোকাবিলা করতে পারেনা। উল্টে নিজেদের দুর্নীতির শাস্তি এড়াতে এরা দ্রুতই বিজেপির সাথে সমঝোতায় আসবে। বরং এই আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত দলটির সর্বাঙ্গীন বিরোধিতা করতেই হবে, সাথে সাথে সাধারণ মানুষকে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্ত করে এই তদন্তগুলি যাতে পরিণতি পায় তা নিশ্চিত করতেই হবে। অন্যদিকে বিজেপির বিরুদ্ধে নিরন্তর রাজনৈতিক প্রচার ও আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। তৃণমূল এবং বিজোপি পরাজয়ের মধ্য দিয়েই পশ্চিমবঙ্গ এই ঘোর অন্ধকার থেকে মুক্তি পাবে।