আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২২ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

ধর্মীয় বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই - এক কঠিন যুদ্ধ

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার


জাতিগত বা ধর্মীয় বিদ্বেষের মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়াই একটি কঠিনতম সংগ্রাম। এই বিদ্বেষ মানুষকে এতটাই অন্ধ করে দেয় যে, তখন কথাবার্তায় বা ব্যক্তিগত আচরণে যুক্তির লেশমাত্র থাকে না। এটা কোনো নির্দিষ্ট দেশের জন্যেই সত্য নয় শুধু। ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তান সহ পৃথিবীর সব দেশেই এই লড়াইটা কঠিন। আধুনিক ইতিহাসে আমরা এমনটাও দেখেছি, বিভেদ ও বিদ্বেষের সংঘাতের রাজনীতি থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসার কয়েক দশক পর আবার জাতিগত বিদ্বেষের আবির্ভাব ঘটছে। ১৯১৭ সালের আগেকার সময়ের রাশিয়াকে বলা হত জাতিসমূহের কারাগার। বলশেভিক বিপ্লব জাতিগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সুনিশ্চিত করার পর মৈত্রী ও সমতার আদর্শের ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতিসমূহের স্বেচ্ছামূলক সঙ্ঘ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম দিয়েছিল। সাত সাতটি দশক পর দেখা গেল জাতিগত বৈরিতা ও অবিশ্বাস সোভিয়েত মহাসঙ্ঘের ভেঙে পড়ায় বড় ভূমিকা নিল। ভাঙন পরবর্তী সময়ে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন জাতির মধ্যে জাতিগত বিদ্বেষ ও সহিংসতার রাজনীতি চরমে উঠল। প্রেসিডিয়াম ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যে বিভিন্ন জাতির সংহতিমূলক সমঝোতায় গড়ে উঠেছিল যুগোশ্লাভিয়া, তাও ভাঙনের পর ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব সংঘর্ষ ও পারস্পরিক হত্যার বধ্যভূমি হয়ে উঠল। অন্ধ বিদ্বেষ সত্যিই কতটা অন্ধ হয় সেটা নিয়ে আইরিশদের শতাব্দী প্রাচীন প্রোটেস্ট্যান্ট রোমান ক্যাথলিক বিভাজন ও বিদ্বেষের একটি গল্প শুনেছিলাম। এক রোমান ক্যাথলিক মেয়ে তার মা'কে বলেছিল, আই ওয়ান্ট টু বি এ প্রস্টিট্যুট। মা উত্তরে নাকি বলেছিল, ওয়াট?? দৃঢ়চেতা মেয়ে আবার বলে, এ প্রস্টিট্যুট। এবারে মা হাফ ছেড়ে বলেন, থ্যাঙ্ক গড। আই থট ইউ আর টার্নিং এ প্রটেস্ট্যান্ট!

সংখ্যালঘুদের উপর প্রাণঘাতী আক্রমণ, জীবন সম্পত্তির ধ্বংস সাধন, প্রতিনিয়ত বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বেপরোয়া ঔদ্ধত্যে বলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতা সংখ্যালঘুদের এই কথাটাই বোঝাতে চায়, এ দেশে অধিকার একমাত্র সংখ্যাগুরুদের, সংখ্যালঘুর নয়। সংখ্যালঘুর কাজ দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে সব মেনে নিয়ে চুপ করে থাকা। না মানলেই শোনানো হবে, ওপারে চলে যাও। যুক্তি দেবে, দেশ তো ভাগই হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে।

আক্রান্ত সংখ্যালঘু এবং অসাম্প্রদায়িক সংখ্যাগুরুরা সবচেয়ে বেশি অসহায় বোধ করে এমন ঘটনা ঘটলে। আক্রান্ত সংখ্যালঘুর সমস্যা এটাই, সে ভাবে তাঁর নিজের ধর্মীয় পরিচয়টাই একমাত্র কারণ তাঁর উপর নেমে আসা আক্রমণের জন্যে। ওটা না থাকলে তার কিচ্ছু হত না। প্রকৃতপক্ষে, ধর্মীয় পরিচয় কারণ হলেও সেটা সেই ধর্মবিশ্বাসীরা সংখ্যালঘু বলেই। এটা সেটা সে বোঝে না। যার জন্যে সে সহমর্মী খুঁজতে চায় সীমান্তের অপর পারের সমধর্মীর মধ্যে। সে বোঝে না অপর পারের সমধর্মীরাও সংখ্যাগুরু হওয়ার ‘বলে বলীয়ান হয়ে’ একইভাবে আক্রমণ নামিয়ে আনছে ওই দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর। ওখানেও ধর্মীয় পরিচয়টা এই আক্রমনের কারণ এই জন্যে যে ওই দেশে আক্রান্তরা সংখ্যালঘু। সে জন্যেই একটি দেশের বা সমাজের সংখ্যালঘুর সহমর্মী প্রকৃতপক্ষে হতে পারে অপরদেশের সংখ্যালঘুরাই, স্বধর্মের সংখ্যাগুরুরা নয়। কিন্তু সেটা হয় না। বাংলাদেশের হিন্দুরা ভাবে ভারতে মুসলিমরা যথেষ্ট অধিকারপ্রাপ্ত। ভারতে সংখ্যালঘু কমিশন আছে। দু'বার রাষ্ট্রপতি হয়েছেন মুসলিম মানুষ। তিনবার উপরাষ্ট্রপতি। একবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বিমান বাহিনীর প্রধান হয়েছে। ক্রিকেট ফুটবলে বারবার মুসলিম অধিনায়ক হয়। ফলে ভারতে মুসলিমরা আমাদের চেয়ে ভালো আছে। আবার, ভারতে মুসলিমরা আক্রান্ত হলে বাংলাদেশের হিন্দুদের সাথে নিজেদের তুলনা করতে শুরু করে। বলে, বাংলাদেশে হিন্দুরা ভারতের মুসলিমদের চেয়ে অনেক ভালো রয়েছে। কারণ জনসংখ্যার শতাংশের চেয়ে চাকরিতে তাদের উপস্থিতি অনেক বেশি। কারণ থানার পুলিশ প্রধান থেকে সচিব পর্যায় অবধি অসংখ্য হিন্দু সমাজের লোক রয়েছে। কারণ সরকার সেখানে দুর্গাপূজার জন্যে অর্থসাহায্য দেয়। আর এখানে ভারতে সরকারি উদ্যোগে মাদ্রাসা তুলে দিচ্ছে আসামে। কোরবানি করতে দিচ্ছে না ইত্যাদি ইত্যাদি।

সংকট এটাই, দুপারের সংখ্যালঘু একে অপরকে স্বগোত্রীয় ভাবে না। তাদেরকে ভাবে তার ওপর নেমে আসা আক্রমনের আক্রমণকারীর দোসর। ফলে আক্রান্ত সংখ্যালঘুত্বের সহমর্মিতা হয় না। ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যেই আশ্রয় খোঁজে। সেজন্যেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের মোদী নিয়ে উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। এটার সুযোগই বাংলাদেশে আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদও জাল বিস্তার করছে সর্বত্র। একই ঘটনা ভারতে। কাশ্মীরের ধর্মনিরপেক্ষ কাশ্মীরীয়তের লড়াই পাকিস্তানপন্থী ধর্মীয় সংগঠনগুলির দখলে চলে গেছে। ভারতেও সংখ্যালঘুরা ওয়েলফেয়ার পার্টি, মিম এদের মধ্যেই আশ্রয় খুঁজতে চায়। এপারে ওপারে এই প্রবণতাগুলি যে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতারই জমি বিস্তৃত করে এবং আরো বেশি আক্রমণের অজুহাত তৈরি করে সেই সচেতনতাও গড়ে ওঠে না।

আবার একইভাবে বড় সমস্যা দু'টি দেশের সংখ্যাগুরু সমাজের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মানুষদের নিয়ে। একটা অংশ সংখ্যালঘু সমাজের অধিকারের স্বপক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে ধর্মীয় অন্ধত্বের পক্ষেও অবস্থান নিয়ে নেয় কখনো কখনো। এতে তাঁর নিজের সমাজের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের রাজনীতির হোতারা পক্ষপাতের অভিযোগ আনার জমি পেয়ে যায়। সাধারণ মানুষও এই অভিযোগের সারবত্তা পায়। এই অংশের অসাম্প্রদায়িকরা নিজের দেশে সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ নেমে এলে যতটা সোচ্চার হয়, অপর পারে সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ নেমে এলে একটু কুন্ঠিত মৃদুতায় প্রতিবাদ করে। ওদের কন্ঠে প্রতিবাদের চেয়ে অস্বস্তিটাই বেশি ধরা পড়ে তখন। বাংলাদেশের সরকার সমর্থক অসাম্প্রদায়িকরা নরেন্দ্র মোদী বা ভারতের বিজেপি শাসন নিয়েও কিছু বলেন না, এড়িয়ে যান। তাঁদের সব বিবেচনাই পাকিস্তান বা বিএনপি কেন্দ্রিক। সব ইস্যুতেই পাকিস্তান ও বিএনপি-র ভূত তাড়া করে বেড়ায়। কে বড় শত্রুর হিসেব করতে গিয়ে ভারতের সংখ্যালঘুদের ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত রাজনৈতিক শক্তি নিয়ে নীরবতা তৈরি হয়।

সংখ্যাগুরু অসাম্প্রদায়িকদের অন্য অংশ নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ নাস্তিকতার জায়গা থেকে 'সব সাম্প্রদায়িকতা নিন্দনীয়' গোছের নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে সংখ্যালঘু সমাজের হাহাকার ও কান্নাকে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতার সাথে গুলিয়ে ফেলে। এদের কাছে জামাত-হেফাজত আর গোবিন্দ প্রামাণিক, এমনকী রাণা দাশগুপ্ত, এপারে মোদী শাহ আর ওয়াইসি, এমনকী শারজিল ইমামও এক হয়ে যায়। 'সব সাম্প্রদায়িকতাই বর্জনীয়' গোছের তথাকথিত নিরপেক্ষতার নামে সে সংখ্যালঘুর ধর্মাচারের উপর আক্রমণের ঘটনাকেও ছোট করে দেখে। ধর্মনিরপেক্ষ নাস্তিকতার প্রচারের নামে কার্যত সংখ্যালঘুর ধর্মীয় স্পর্শকাতরতায়ও নির্বিচারে আঘাত করতে থাকে। অসাম্প্রদায়িকদের এই অংশ বোঝে না ধর্মের বিরুদ্ধে নাস্তিকতার প্রয়োজনীয় লড়াইটা ধর্মের ভেতর থেকে, ধর্মীয় সমাজের ভেতর থেকে জন্ম নেয়। অপর ধর্মের সমাজ থেকে সেটা নেমে এলে সেটা বাইরের অবাঞ্ছিত আগ্রাসন বলে প্রতীয়মান হয়। রবীন্দ্রনাথের 'গোরা' উপন্যাসের গোরা গোড়ায় ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে থাকলেও হিন্দু ধর্মের বিষয়ে খ্রিস্টান ব্রিটিশদের অত্যুৎসাহী হস্তক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় গোঁড়া হিন্দুতে পরিণত হয়। শেষে গোরার যে উত্তরণ ঘটে তা স্বধর্মের অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা ও সমালোচনার মধ্য দিয়ে। শাসিত বা সংখ্যালঘুর এটাই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।

বাংলাদেশে নড়াইলে যেদিন সংখ্যালঘুর বাড়ি পুড়ছে, সেদিন বরাক উপত্যকায় সংখ্যালঘুর বাড়ি ভাঙা হচ্ছে বুলডোজারে। নড়াইলের আক্রান্ত আসামের আক্রান্তের খবর জানে না। আসামের আক্রান্তের কাছেও কেউ পৌঁছে দেয়নি নড়াইলের কথা। এই আক্রান্তের সহমর্মিতা গড়ে তোলার কথা ছিল যে সংখ্যাগুরু অসাম্প্রদায়িকদের, তারা নিজেরাই জানে না কীভাবে লড়তে হয় ধর্মীয় বিদ্বেষের রাজনীতির বিরুদ্ধে। বিশেষ করে আজকের সময়ে। তাদের অস্বস্তি কিংবা উন্নাসিক উদাসীনতার মধ্যেই কাঁটাতারকে তুচ্ছ করে দু'পারের আকাশ বাতাসকে বিদীর্ণ করছে সংখ্যালঘু মানুষের কান্না, হাহাকার। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে সভ্য সমাজে।