আরেক রকম ● দশম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১-১৫ আগস্ট, ২০২২ ● ১৬-৩১ শ্রাবণ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

মহাকাশের দূরবীন - জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ

ঋক চট্টোপাধ্যায়


১২ জুলাই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট প্রকাশ করলেন একটা ছবি যা গোটা দুনিয়াকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিল। নিকষ অন্ধকারের ভেতর আলোর ফুলঝুড়ি। কি এমন বিশেষত্ব এই ছবির যা নিয়ে গোটা দুনিয়া এত মাতামাতি করছে? নাসা জানাচ্ছে এই ছবিটা ১,৩০০ কোটি বছর আগের একটা ছবি। এও কি সম্ভব! আধুনিক মানব জাতিটারই তো বয়স মেরেকেটে কয়েক হাজার বছর হবে। তাহলে তার আবির্ভাবের বহু আগের এই ছবি সে পেল কি করে? এখানেই বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও প্রযুক্তির কেরামতি যে মহাবিশ্বের একটা পুঁচকে গ্রহে বসে থাকা মহাবিশ্বে সদ্য আবির্ভূত হওয়া মানুষ মাটি থেকে বসেই এই বিশ্ব সৃষ্টির প্রায় ব্রাহ্মমুহুর্তের ছবি তুলে ফেলছে। এই ক্যামেরা মানুষ বসিয়েছে মহাশূন্যে। এটা আদতে একটা টেলিস্কোপ বা দূরবীক্ষণ যন্ত্র। এর পোশাকি নাম জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। কিন্তু এই দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে এতকাল আগের ছবি কীভাবে দেখা সম্ভব হচ্ছে? এর পিছনে লুকিয়ে আছে বিজ্ঞানের একটি সহজ ধারণা।

আমরা সময় বলতে আদতে কি বুঝি এই কথাটা পরিস্কার হলেই বুঝতে পারব কীভাবে এতকাল আগের মহাবিশ্বকে এখন বসে দেখা সম্ভব হচ্ছে। আমরা যখন মুহূর্ত বলি তখন আমরা সময়ের একটা খুব ছোট্ট অংশকে বোঝাই। যখন দুটো ঘটনা একই মুহূর্তে ঘটে তখন আমরা ঘটনা দুটিকে বলি সমাপতন। যেমন ধরা যাক, আপনি তালি বাজালেন। আপনি দেখলেন, যখনই দুটো হাতের তালুর ঠোকাঠুকি হল তখনই আপনি তালির শব্দটাও শুনলেন। আপনি বললেন দুটো ঘটনা একসাথে ঘটছে, অর্থাৎ দুটো তালুর ঠোকা লাগা আর শব্দ হওয়া। কেন একসাথে ঘটছে বলছেন, কারণ তালুদুটোর পরস্পরকে স্পর্শ করা যখন আপনি দেখছেন ঠিক তখনই শব্দটাও আপনার কানে এসে ঢুকছে, অর্থাৎ দুটো ঘটনা একই সাথে ঘটছে। এবার ভাবুন, উৎসবের রাতে দূরে যখন বাজি ফাটে তখন অনেক সময় আপনি আগে বাজি ফাটার আলো দেখতে পান, তার খানিক পরে আপনি বাজি ফাটার শব্দটা পান। তখন কিন্তু আপনি আর বলতে পারেন না যে দুটো ঘটনা একসাথেই ঘটেছে। আপনি বলবেন আগে আলো দেখেছেন, তারপর আওয়াজ পেয়েছেন। তার মানে যদিও বাস্তবে দুটো ঘটনা একসাথে ঘটেছে, কিন্তু আপনার কাছে ঘটনা দুটি আর তাৎক্ষণিক রইল না। এর কারণ আলো শব্দের চেয়ে জোরে ছোটে, তাই আলো আগে আসে। আওয়াজটা পরে আমরা পাই।

এবার ভাবুন দুটো ঘটনা মহাবিশ্বের দুটো আলাদা জায়গায় একই সাথে ঘটছে। কিন্তু যে ঘটনা আমাদের কাছে ঘটল তার থেকে আলো আমাদের কাছে আগে এসে পৌঁছবে আর যেটা দূরে সেটা থেকে আলো যতক্ষণ না আমাদের কাছে এসে পৌঁছবে ততক্ষণ আমাদের সাপেক্ষে ঘটনাটা ঘটেইনি। তাহলে আমাদের সময়ের মাপকাঠিতে একটা ঘটনা আগে ঘটছে, আর একটা পরে। অন্যভাবে দেখলে আমরা যখন দূরের ঘটনাটা প্রথমবার দেখতে পাব, সেটা আসলে তার বর্তমান নয় আগের অবস্থা। একটা বাস্তবিক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সূর্য থেকে আমাদের কাছে আলো আসতে ৮ মিনিট মত সময় লাগে। তার মানে আমরা যখন সূর্যকে দেখি সেটা তার তাৎক্ষণিক নয়, বরং ৮ মিনিট আগের দশা। তার মানে সূর্য নিভে যাওয়ার ৮ মিনিট পর আমরা সূর্যকে নিভতে দেখব। তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে কোনো ঘটনা থেকে আলো আসতে যত সময় লাগে, আমরা তার তত আগের অবস্থাকে আসলে দেখি।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ছবি তুলেছে মহাকশের এমনই এক অংশের যেখান থেকে আলো আসতে সময় লাগে ১,৩০০ কোটি বছর। তার মানে আমরা এখন তাকিয়ে যা দেখলাম সেটা আসলে ১,৩০০ কোটি বছর আগের অবস্থা। সুতরাং মহাবিশ্বের প্রথম দিককার চেহারা জানতে গেলে আমাদের অনেক দূরের দিকে তাকাতে হবে। যত দূরে দেখতে পাব, তত অতীতের ঘটনা দেখতে পাব। ঠিক এই নীতির উপর নির্ভর করেই কাজ করছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। সে ক্রমাগত চেষ্টা করে চলেছে দূর থেকে আরও দূরের দিকে তাকানোর। কেবল দৃশ্যমান আলোই নয়, বরং অবলোহিত বা ইনফ্রারেড আলোর ছবিও তুলতে। কেন অবলোহিত রশ্মির দরকার? আমরা জানি যে আমাদের মহাবিশ্ব ক্রমপ্রসারমান। অর্থাৎ প্রতিটি ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি পরস্পরের থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের ডপলার সূত্র বলছে যদি কোন আলোক উৎস পর্যবেক্ষকের থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যায় তবে ওই উৎস থেকে নির্গত আলো ক্রমশ পর্যবেক্ষকের চোখে লাল রঙের দিকে সরে যাবে বা বিজ্ঞানের ভাষায় তার তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য বড় হতে থাকবে। একে 'ডপলার সরণ' বলা হয়। সুতরাং যে ছায়াপথ অনেক দূরে তার থেকে আগত আলোকরশ্মির এই ডপলার সরণ অনেক বেশী। ফলত যদি আমাদের দূর অতীতের দিকে তাকাতে হয় তাহলে অনেক দূরের ছায়াপথকে দেখতে হবে এবং সেই ছায়াপথ থেকে আগত আলোর ডপলার সরণ এতই বেশী হবে যে তা অবলোহিত তরঙ্গে পরিণত হবে। তাই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ মূলত আবলোহিত আলোর উৎসই খুঁজতে চাইছে।

চিত্র ১. নাসার প্রকাশিত জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে তোলা এসএমএসিএস ০৭৩২ ছায়াপথ পুঞ্জের ছবি। বামদিকের ছবিটি তোলা মিডল ইনফ্রারেড আলোয় এবং ডানদিকের ছবিটি তোলা নিয়র ইনফ্রারেড আলোতে।

এই দুটি ছবি পাশাপাশি দেখলে তবেই নক্ষত্র আর ছায়াপথদের ঠিকভাবে চেনা সম্ভব। যেমন, ডানদিকের ছবিতে যে উজ্জ্বল নীলাভ বিন্দুটি অনেকগুলো ছটা নিয়ে দেখা দিচ্ছে বামদিকের ছবিতে সেটির ছটা কমে গেছে এবং নীল রঙটি গাঢ় হয়ে উঠেছে। তার থেকে বোঝা যাচ্ছে এটি একটি নক্ষত্র। আবার বামদিকের ছবিতে যে নীল বিন্দুগুলি ছটা ছাড়া রয়েছে সেগুলো হল ছায়াপথ। অর্থাৎ ডানদিকের ছবির মাঝের সাদা উজ্জ্বল বিন্দুটি হল একটি ছায়াপথ যার পোশাকি নাম হল এসএমএসিএস ০৭৩২। এই ছবিটির আরও একটি বিশেষত্ব আছে। যদি ডানদিকের ছবিটির কেন্দ্রের দিকে আমরা তাকাই, অর্থাৎ এসএমএসিএস ০৭৩২ যেখানে দেখা যাচ্ছে, তার আশেপাশের সমস্ত আলোক বিন্দুগুলি একটু লম্বাটে লাগছে। দেখার কথা ছিল গোল। এর কারণ কী?

আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে আমরা যদি একটি লাঠিকে জলে আংশিক ডুবিয়ে রাখি তাহলে লাঠিটি বাঁকা লাগে। চিত্র ২ দেখুন। এর কারণ হল আলোর স্বাপেক্ষে জল ও বাতাসের ঘনত্ব আলাদা। ফলে দুটি মাধ্যমে আলোর গতিবেগ ভিন্ন। ফলে আলো যখন জল থেকে বাতাসে প্রবেশ করে তার গতিপথ বেঁকে যায়। একে আলোর 'প্রতিসরণ' বলে। এখানে পেন্সিলের উপরের অংশ জলের বাইরে আছে। ফলে ওই অংশ থেকে প্রতিফলিত আলো সোজা পথে আমাদের চোখে এসে পড়ছে। কিন্তু যে অংশ জলের ভেতর আছে সেখান থেকে প্রতিফলিত আলো আমাদের চোখে আসার সময় প্রথমে জল থেকে বাতাসে প্রবেশ করছে আর তখনই তার গতিপথ বেঁকে যাচ্ছে। ঠিক একই নীতির ওপর নির্ভর করে আতসকাঁচ আলোকে বাঁকিয়ে দেয় (চিত্র ৩)।

চিত্র ২. জলের ভেতর আলোর প্রতিসরনের ফলে লাঠির আপাত বক্রতা। (চিত্রসূত্রঃ গুগল ইমেজ)

চিত্র ৩. উত্তল আতসকাঁচের দ্বারা আলোর গতিপথ পরিবর্তন। (চিত্রসূত্রঃ গুগল ইমেজ)

কিন্তু এই প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক যে আলো কীভাবে এই মাধ্যমের পরিবর্তন বুঝতে পারছে? আসলে আলোর নিজের বোঝার উপায় নেই যে মাধ্যমটি আসলে ঘন না লঘু। আদতে এটা ঘটছে আলোর গতিবেগের তারতম্যের কারণে। তার মানে যদি কোন বিন্দুতে আসা দুটো পথে আলোর গতি দু'রকম হয় তাহলে এই ঘটনা ঘটবে। এবার উল্টো করে বলা যায় যে, যদি দুটো পথের দৈর্ঘ্য দু'রকম হয় তাহলেও একই ঘটনা ঘটবে। তার মানে মাধ্যমের ঘনত্ব পরিবর্তিত না হয়ে যদি আলো আসার পথদুটির দৈর্ঘ্য আলাদা হয়ে যায় তাহলেও এমনটা ঘটবে। চিত্র ১-এর ক্ষেত্রেও এই ধরণের ঘটনা ঘটেছে। এখানে আলোর গতিপথ পরিবির্তিত হয়েছে ছায়াপথের মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে। এই ঘটনাকে বলা হয় 'গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং'।

আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার সূত্র বলে যে, আমাদের বিশ্বের সমস্ত বস্তুই একটি চারমাত্রিক জগতে আছে। তিনটি মাত্রা হল স্থানের অর্থাৎ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা এবং চতুর্থ মাত্রা হল সময়। সুবিধার জন্য যদি আমরা স্থানের তিনটি মাত্রাকে একসাথে করে নিই তাহলে একটি দ্বিমাত্রিক তল দিয়েই বিশ্বের যে কোন বস্তুর অবস্থান প্রকাশ করা যায়। একটি মাত্রা হবে স্থানের এবং অপরটি কালের বা সময়ের। তার মানে কোনো বস্তু কখন কোথায় আছে তা এই স্থান কালের চাদরের ওপর একটি বিন্দু দিয়েই প্রকাশ করা সম্ভব। সাধারণ আপেক্ষিকতার সূত্র বলছে যে, বস্তুর ভর যদি খুব বেশী হয় তাহলে ঐ বস্তু তার পারিপার্শ্বিক স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয় (চিত্র ৪)।

চিত্র ৪. ভরের কারণে স্থান কালের বক্রতা। (চিত্রসুত্রঃ গুগল ইমেজ)

এখন আলোকেও এই স্থান কালেই চলতে হয়। ফলে যদি কোথাও স্থান কালে বক্রতার সৃষ্টি হয় তাহলে আলোকেও তার সাথে তাল মিলিয়ে বেঁকে যেতে হয়। ঠিক এই কারণেই যখন আলো এসএমএসিএস ০৭৩২ ছায়াপথের পিছনে থাকা তারাগুলি থেকে এসেছে তখন তারা সোজা পথে না এসে বেঁকে এসেছে। সে কারনেই বিন্দুবৎ তারাগুলি লম্বাটে দেখতে লাগছে। চিত্র ৫ দেখলে বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবে।

চিত্র ৫. ছায়াপথের পিছনে থাকা নক্ষত্রপুঞ্জের আলো গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং-এর জন্য বেঁকে যাচ্ছে। (চিত্রসূত্রঃ গুগল ইমেজ)

কিন্তু এমন মহাকাশের ছবি তো আগেও আমরা দেখেছি। তাহলে এই ছবি নিয়ে এত মাতামাতি কেন? এর দুটি কারণ। প্রথমত মহাকাশে এহেন একটি টেলিস্কোপ স্থাপন করাই প্রযুক্তির দিক থেকে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। একে তো এই টেলিস্কোপের আকার বিরাট। এই টেলিস্কোপ আছে মহাশূন্যে, পৃথিবী থেকে ১০ লক্ষ মাইল দূরে। সুতরাং এটিকে একবারেই ঠিক করে স্থাপন করতে হত। তারপর মহাশূণ্যে সূর্য্যের তাপের থেকে বাঁচাতে একে আড়াল করতে হয়েছে টেনিস কোর্টের সমান মাপের ৫টি পর্দা দিয়ে। ফলে প্রযুক্তিগত দিক থেকে এটি একটি বিরাট কর্মযজ্ঞ ছিল। দ্বিতীয়ত, আমরা এতদিন মহাবিশ্বের এত দূরের ছবি তুলতে পারিনি। এই ছবি বিশ্বসৃষ্টির তত্ত্বগুলিকেও প্রমাণ করতে সাহায্য করছে। যেহেতু মহাকাশে দূরে তাকানো মানে আদতে অতীতে তাকানো, সুতরাং এই বিশ্ব সৃষ্টির মুহূর্তে কেমন ছিল তার একটা ধারণা আমরা ক্রমে পেতে থাকব। বিজ্ঞানের সূত্রগুলির প্রত্যক্ষ প্রমাণ, যা আজকের সমাজে খুবই জরুরী, বিশ্বসৃষ্টির একটি প্রামাণিক তত্ত্ব আস্তে আস্তে একটি সামগ্রিক বিজ্ঞান মনস্কতা তৈরীতে সাহায্য করবে এই টেলিস্কোপের কর্মকান্ড।