আরেক রকম ● দশম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২২ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৯

প্রবন্ধ

এপাং ওপাং ঝপাং

অর্ধেন্দু সেন


এপাং ওপাং কি বস্তু সঠিক জানিনা কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে ঝপাং শব্দটি আদিরসাত্মক। কথাটির মধ্যে একটা বেহিসেবি আত্মসমর্পণের ব্যাপার আছে। হ্যাঁ, সে এক ইংরেজ কবি ছিলেন বটে টি এস ইলিয়ট যিনি পিচ খেতেও ভয় পেতেন। পিচ মানে আড়ু আরকি। সাহেবের পিচ খাওয়া বলতে নিদেনপক্ষে ড্রেসিং গাউন পরে টেবিল চেয়ারে বসে প্লেট ন্যাপকিন ছুরি কাঁটা সহকারে পিচ খাওয়া। কিন্তু তাতে কি হয়? পিচের তীক্ষ্ণ টক স্বাদ মুহূর্তেকের তরে যদি বাপের নাম ভুলিয়ে দেয়? শিল্পবিপ্লব সমৃদ্ধ পশ্চিমী সভ্যতার শিক্ষা সংস্কৃতি আদব কায়দা যদি তুচ্ছ মনে হয় ম্লান মনে হয়? ইলিয়টের পক্ষে সম্ভব ছিল না অতো বড় ঝুঁকি নেওয়া। আমাদের কবি শিক্ষা দীক্ষা আদব কায়দা ওসব ন্যাকামির মধ্যে নেই। তিনি ঝাঁপ দিতে ভয় পান না।

আর যারা প্রণব বর্ধনের 'স্মৃতি কণ্ডুয়ন' পড়েছেন তাদের তো ফুলমনির গল্প মনে পড়বেই। গৃহস্থের বাড়ির কাজ সেরে নিজের বাড়ি ফেরার পথে ফুলমনির অভ্যাস ছিল পুকুরে স্নানটা করে নেওয়া। সবার ভাগ্যে তো ফুলমনির মতো মিউস জোটে না। তাই আমরা যেখান থেকে পারি অনুপ্রেরণা জোগাড় করি। যে কবি কবিতার প্রথম পঙক্তিতেই পাঠক পাঠিকাকে ডুবাইলা প্রেমরসে করে ফেলতে পারেন তিনি যদি তিন বছর অন্তর ত্রিবার্ষিক পান, তাহাতে আছে বল ক্ষতি কার? মুখ্যমন্ত্রীর লেখা কবিতার বই পুরস্কার পাওয়াতে সাধারণ মানুষ খুশি। হইচই করছে কিছু বামপন্থী বাবুরা। আকাদেমির অধ্যক্ষ তো বলেইছেন যে, বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের মতামত নেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে বিরোধীরা অনেক খুঁজেও মাত্র দুজনের ক্ষেত্রে কিছুটা 'কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট' পেয়েছে। এক আকাদেমির অধ্যক্ষ যিনি মন্ত্রীসভার সদস্যও বটেন। দুই বইটির প্রকাশক।

হ্যাঁ, আপনিও বলতে পারেন কাজটা অনুচিত হয়েছে। চাটুকারিতা আর চামচেবাজির বীভৎস প্রদর্শন হয়েছে। রাজ্যে সাহিত্য সাধনার উপর এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। যারা চাটুকারিতার ধার ধারেন না সত্যিকারের উৎকর্ষের সন্ধানে ব্যস্ত তারা হতাশ হবেন। কিন্তু এটা একটা বিশেষ পুরস্কার বিশেষ প্রতিভাবানদের জন্য যারা রাজনীতিতে আছেন অথবা প্রশাসনে আছেন কিন্তু নিজেদের গুরুদায়িত্ব পালন করেও কবিতা লেখেন। একে একটু অন্য চোখে দেখতে হবে। ফাইন আর্টসের আকাদেমিও পারে এই রকমের একটি পুরস্কারের আয়োজন করতে। প্রথম পুরস্কার মমতাই পাবেন। অফিসারদের মিটিঙে বসে ওনার নিরলস ছবি আঁকার গল্প অন্যত্র বলেছি। আবার বলা উচিত হবে না। ইকির মিকির অথবা টাপা টিনি গানের লেখকেরা কিন্তু এই পুরস্কার পাননি। কারণ তাঁরা প্রশাসক নন।

শুধু শিল্পী সাহিত্যিকদের উপর এই পুরস্কারের প্রভাব দেখলে তো চলবে না। আগামী প্রজন্মের মুখ্যমন্ত্রীদের উপর এর একটা ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চয়ই থাকবে। তাঁদের কাছে যদি স্পষ্ট বার্তা পৌঁছয় যে শুধু কাটমানি নয়, শুধু গুন্ডা কন্ট্রোল নয়, থানায় ঢুকে আসামী ছাড়িয়ে আনা নয়, একে ওকে প্রটেকশন দেওয়া নয়, প্রতিবাদ করলেই আঠারোটা কেস দেওয়া নয়, নিয়মিত দিনে আধঘণ্টা কাব্যচর্চা করেও খ্যাতির শিখরে ওঠা যায় তাহলে তাঁরা তো উপকৃত হবেনই রাজ্যের মানুষও ধন্য হবে। ইতিমধ্যে লেখিকা রত্না রশিদ ব্যানার্জি প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাঁর আকাদেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়ে। অনাদিরঞ্জন বাবু জাতীয় সাহিত্য আকাদেমির উপদেষ্টার পদ ত্যাগ করেছেন। এদের সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা জানিয়েই বলতে চাই এনারা হয়তো পুরো ব্যাপারটা হিসেবের মধ্যে রাখেননি।

সমস্যা হল ভদ্র বাঙ্গালি সমাজের রুচি ঠিক করে দিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ। সে তার অনেক উঁচুতে বাঁধা। বাঙ্গালি ভদ্দরলোক তাই শিল্প সাহিত্যের জগতে মমতাকে প্রবেশাধিকার দিতে চান না। রোদ্দুরকেও না। মুখ্যমন্ত্রী সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় দিন, তোলাবাজিকে, কাটমানিকে প্রশ্রয় দিন, বখাটে ছেলেদের মাথায় তুলুন। বাঙ্গালি বাবু বিরক্ত হবেন প্রাইভেটে দু'চার মন্তব্যও করবেন কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু নাও বলতে পারেন। কিন্তু তিনি ছবি আঁকবেন? কবিতা লিখবেন? এই অনধিকার প্রবেশ মেনে নেওয়া যায় কি করে? ছবির বেলায় ভদ্র সমাজকে বাঁচিয়েছেন সুদীপ্ত সেন। একটা ছবি দুই কোটি টাকা দিয়ে কিনে সেটা প্যাকিং বাক্স থেকে বের করেননি। ভাঁড়ার ঘরে টাঙ্গানো যেত। তাও করেননি। বাঙ্গালি হিসেবে আমরা অনেক জবাবদিহি থেকে মুক্তি পেয়েছি।

কবিতার ক্ষেত্রে গোলমাল করেছেন কবি নিজেই। একশ'র বেশি কবিতার বই ছাপিয়েছেন। সবাই জানে পরিমাণ এত বেশি হলে মান ঠিক রাখা যায় না। সবাই তো রবীন্দ্রনাথ নন। তাই মানের প্রশ্ন ওঠেনি। সাহিত্যের পত্রপত্রিকায় বা সচেতন বাংলা সংবাদ মাধ্যমে এ বিষয়ে কোনও বিতর্ক হয়নি কোনোদিন। উনি লিখছেন, লিখুন না! কেউ তো আমাদের বাধ্য করছে না পড়তে! এই স্তরেই ছিল ব্যাপারটা। হঠাৎ জীবনানন্দ ঘাঁটতে গিয়ে ব্রাত্যবাবু বুঝলেন সমস্যা মমতাকে নিয়ে নয় সমস্যা তাঁর পাঠক পাঠিকাদের নিয়ে।

এক নম্বর সমস্যা বাঙ্গালি সাহিত্য বোঝেনা। রবীন্দ্রনাথের অক্লান্ত পরিশ্রমে কিছু লোক সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন কিন্তু তাঁদের সংখ্যা নগণ্য। দুই নম্বর বাঙ্গালি সমাজে কবি হতে গেলে একটু মুখচোরা হতে হয়। নিজের কবিতা ছাপাতে কবির শুধু অনীহা নয় রীতিমতো সঙ্কোচ থাকবে। হয়তো দেখা যাবে কবির জীবদ্দশায় কবিতা ছাপাই হল না। মৃত্যুর পরে বেরোল পাণ্ডুলিপি। আমাদের সাহিত্য না বোঝা মমতার কবি হবার পক্ষে অনুকুল হলেও হতে পারে। কিন্তু মুখচোরা? ব্রাত্য বুঝলেন সমস্যাসঙ্কুল পথ। সমালোচনা কিছুটা হবেই। কিন্তু বাংলা বনধ নিশ্চয়ই হবেনা।

গোড়াতেই বলেছি আমি সাধারণ বাঙ্গালির মতো নই। আমি কবি মমতার ভক্ত। শুধু আদি রসের জন্য নয়। ওনার কবিতা বাচ্চারা ভালবাসে তাই চরিত্র গঠনের সব উপাদানই থাকে কবিতায়। 'উপলব্ধি', 'অবিশ্বাস্য', 'ক্রোকোডাইল আইল্যান্ড', 'মানবিক', 'জন্মাইনি', 'পল্লবী', 'অশুভ সঙ্কেত', 'মা', 'জনতার দরবার' বইগুলি এখনও পড়ে ওঠা হয়নি তবে 'আজব ছড়া' আমি পড়েছি। এই বইয়ে রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ তো আছেনই। আছেন কবি নজরুল। দেশভক্তি দেশাত্মবোধের কথা আছে। পরিবেশ প্রেম রয়েছে বড় আকারে। পাহাড় নদী ঝরনা আছে। বাঘ সিংহ কুমির আছে। বস্তুত চিড়িয়াখানার নাম করে উনি আমাদের সোজা নিয়ে গেছেন সুন্দরবন। বেদ বাইবেল কোরান আছে। আছে গুরুগ্রন্থ। ত্রিপিটক। আছে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কথা।

বইটি শুধু শিশু নয় তার মা বাবাও পড়বে। তাই পরিষ্কার বলা আছে বড় হওয়া মানে শুধু পড়াশোনা নয়। শুধু হোমওয়ার্ক আর ভারী ইশকুল ব্যাগ বওয়া নয়। খেলাধুলা শরীর চর্চাও তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আশ্চর্য হয়েছিলাম দেখে যে, ঢেউ গোনার কথা ফিরে ফিরে এসেছে এই সঙ্কলনে। পরে বুঝলাম ছেলে মেয়েদের শিক্ষা দিয়ে চাকরি না দিতে পারার দুঃখ ওনাকে বিচলিত করে। শোভনদেবও একই আক্ষেপ করেছেন।

এতক্ষণে এই কথাই প্রতিষ্ঠা করেছি যে মমতাকে পুরস্কার দেওয়ায় ঝুঁকি ছিল কিন্তু যুক্তিও ছিল। কোনও প্রয়োজন ছিল কি? তা নিয়ে দু'চার কথা না বললেই নয়। তৃতীয়বার জিতে এসে মমতার সময়টা ভাল যাচ্ছিল না। আনিস হত্যায় খুনের অভিযোগ হল পুলিশের নামে। বগটুই কাণ্ডে আনারুল সময়মতো পুলিশ পাঠাল না। মুখ্যমন্ত্রীর মুখ পুড়ল যা আগে কখনো হয়নি। সবই হাসিমুখে সহ্য করেছেন তিনি। কিন্তু হাইকোর্টের মামলায় দেখা গেল শিক্ষা দপ্তরে পাহাড় পরিমাণ দুর্নীতি।

নির্বাচনে নিজের মেয়েকে চাওয়া অনৈতিক কাজ কিন্তু বেআইনি নয়। পরেশ নিজের মেয়েকে চেয়ে এক বেআইনি কাজ করে বসলেন। পার্থ বললেন দায়িত্ব আমার একার নয়। মন্ত্রীসভার যৌথ দায়িত্ব। মানে তিনি যা করেছেন মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়েই করেছেন। 'আমি জানতাম শিক্ষাই আমার কাল হবে' - এ ধরনের স্বগতোক্তি শুনতে শুনতে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু ঠিক করলেন একটা কিছু করা দরকার। বাকি ঘটনা আমাদের জানা। ধর্মরাজ্যে আবার শান্তি ফিরে এসেছে। ভিড় জমছে স্কাই ওয়াকে। ক্লাস ফাইভের বাচ্চারা পড়ছে -

দেখি কেমন বলতে পারো
সমুদ্রের ঢেউয়ের সংখ্যা
কোন সমুদ্র সবার বড়
আর কোথায় পাওয়া যায় লঙ্কা?