আরেক রকম ● দশম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যা ● ১-১৫ জুলাই, ২০২২ ● ১৬-৩১ আষাঢ়, ১৪২৯

প্রবন্ধ

শংকর সেন

অমিয় দেব


বাহাত্তর-তিয়াত্তরের একটা ছবি মনে পড়ে। বুদ্ধদেব বসু বোধহয় তখন ‘মহাভারতের কথা’ লিখছেন। তাঁর টেবিল-ল্যাম্পের পাশেই এক মাটির রেকাবিতে তিন-চারটে মোটা মোমবাতি বসানো। বিদ্যুৎ চলে গেলেই মোমবাতি কটা জ্বালিয়ে নিতেন। তেমন উজ্জ্বল না হলেও সেই আলোতে লিখতে শিখিয়েছিলেন নিজেকে। আর বিদ্যুৎ তো তখন প্রায়ই চলে যেত। একটা শব্দও চালু হয়েছিল তা নিয়েঃ লোডশেডিং। আগে থেকে জানা যেত না তা কখন ঘটবে। পরে অবশ্য একটা রুটিনও তৈরি হয়েছিল - কোন অঞ্চলে কখন বিদ্যুৎ থাকবে না তা আগেই জানিয়ে দেওয়া হত। ব্যতিক্রম হাসপাতাল, বৈদ্যুতিক চুল্লি-সমন্বিত শ্মশান ও অনুরূপ কিছু জায়গা। আমাদের বিঘ্নিত দিনানুদিনও সেই অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হতে লাগল। সেই সঙ্গে জেনারেটার আর ইনভার্টার-এর ব্যবসাও ফেঁপে উঠল। সত্তর ও আশির দশকের সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতা এখন স্মৃতি। আর তার জন্য আমরা যাঁর কাছে ঋণী তিনি শংকর সেন।

শংকর সেন পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎমন্ত্রী হন ১৯৯১-তে। ছিলেন ১৯৯৯ পর্যন্ত। এই ন-বছরে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার হাল পাল্টে দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, তা সম্ভব হয়েছিল অনেকটাই তাঁর শিবপুর বি. ই. কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের জন্য। তাঁর হাতে ইলেক্ট্রিক্যাল এঞ্জিনীয়ারিংয়ে দক্ষ হয়ে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় বিদ্যুতের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর ডাকে তাঁদের মধ্যে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। তাঁর মন্ত্রিত্বের গোড়ার দিকে নাকি এক সাংবাদিক তাঁকে বলেছিলেন, তিনি কী করে জেনারেটার-ইনভার্টার ব্যবসাকে কাবু করবেন ভেবেছেন? নিষ্ঠা ও বুদ্ধিমত্তার সংযোগে যে ইত্যাকার অনেক সমস্যাই মেটানো যায়, তার উদাহরণ তিনি দিয়েছিলেন। আমি তখন মেদিনীপুরে, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে; বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ার বিদ্যুৎ যাতে আপেক্ষিকভাবে অক্ষুণ্ণ থাকে তার জন্য তাঁর কাছে আবেদন করেছিলাম। মন্ত্রী হবার আগে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের উপাচার্য ছিলেন - সেই সুবাদে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগে আমার দ্বিধা হয়নি। কারণও ছিল না, কেননা তিনি খুব সহজ মানুষ ছিলেন। লাল ফিতের কোনো বালাই ছিল না তাঁর মন্ত্রিত্বে। তিনি কোলাঘাট আসছিলেন; আমাকে তাঁর কাছে সেখানে আসতে বললেন। আমি যেতেই স্থানীয় আধিকারিককে দিয়ে আমাদের সমস্যার সমাধানও করিয়ে দিলেন।

তিনি মন্ত্রিত্বে যোগ দেবার কয়েক মাসের মধ্যেই, আমাদের সায়েন্সের ডীন অশোকনাথ বসু ও আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তাঁর দপ্তরে। তাঁর চেয়ারের পিছনে, দেখি, পশ্চিমবঙ্গের এক বিরাট মানচিত্র। তাতে বিদ্যুৎ সরবরাহের সব খুঁটিনাটি চিহ্নিত। যেখানে যেখানে সমস্যা তিনি সেখানে নিজেই চলে যাচ্ছেন। প্রায় যুবকের মতো উৎসাহ - তখন বয়স তেষট্টি। তাঁর অনুসরণেই আমি মেদিনীপুর গিয়ে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিভুক্ত সব কলেজের অবস্থান চিহ্নিত করে, সে-জেলার এক মানচিত্র আমার পিছনে ঝুলিয়ে রাখলাম। আমি যে সেই কলেজগুলিতে অন্তত একবার গেছি তার প্রাথমিক প্রণোদনা যেমন সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের তেমনি উদাহরণ ওই তরতাজা বিদ্যুৎমন্ত্রীর। অবশ্য তন্নিষ্ঠার পাঠ আমি তাঁর কাছ থেকে নিতে শুরু করেছিলাম আগেই, যখন তিনি যাদবপুরে উপাচার্য ও আমি আর্ট্‌স ফ্যাকাল্টির ডীন।

যাদবপুরের পরীক্ষা-দপ্তরের সহকারী নিয়ামক নীরেন গুহচৌধুরী বলতেন, ডঃ ত্রিগুণা সেনের পরেই ডঃ শংকর সেন। তাঁকে আমরা ডাকতামও ডঃ সেন বলে। শংকরবাবু বলতাম না। তাঁকে একবারই শংকরবাবু বলতে শুনেছিলাম; মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখে - ১৯৯১-তে ডঃ সেনকে যে বিদায় জানায় যাদবপুরের কর্মচারী সংসদ তাতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমন্ত্রিত ছিলেন। ডঃ সেন যাদবপুর এলেন ১৯৮৬-তে। পড়িয়েছেন এক এঞ্জিনীয়ারিং কলেজে; এখানে এঞ্জিনীয়ারিংয়ের সঙ্গে আরো দুটো ফ্যাকাল্টি আছে।এঞ্জিনীয়ারিংকেই মুখ্য না মেনে তিনি আর্ট্‌স ও সায়েন্সকে সমান মর্যাদা দিলেন। তিন ফ্যাকাল্টির একটা প্রাথমিক সম্পর্ক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু সেটা রুটিনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল - সত্যিকার আদান-প্রদান ছিল না। এই ফ্যাকাল্টি-সর্বস্বতার হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ডঃ সেন কয়েকটি ‘ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি স্কুল’ প্রবর্তন করলেন। ‘স্কুল’ প্রথাসিদ্ধ ‘বিভাগ’ নয়, তাতে কোনো ডিগ্রিকামী পাঠক্রম থাকবে না; তার মুখ্য কাজ হবে গবেষণা। এবং তাতে যে-কোনো ফ্যাকাল্টির যে-কোনো বিভাগের শিক্ষক বা গবেষক যুক্ত হতে পারবেন। উচ্চশিক্ষায় একটা নতুন দরজা খুলল।

উচ্চশিক্ষায় যে কম্প্যুটারের সহায়তা দরকার, সেই বোধও ডঃ সেন সঞ্চার করলেন যাদবপুরে। প্রথমে এঞ্জিনীয়ারিং-এ। ‘ইলেক্ট্রনিক্‌স ও টেলিকম্যুনিকেশন’ থেকে জন্মাল আরো দুটো বিভাগঃ ‘কম্প্যুটার সায়েন্স এঞ্জিনীয়ারিং’ ও ‘ইনস্ট্রুমেন্টেশন এঞ্জিনীয়ারিং’। ‘প্রিন্টিং এঞ্জিনীয়ারিং’ নামের এক অভিনব বিষয়ও শুরু করলেন ডঃ সেন যার ব্ল্যাকবোর্ড হল কম্প্যুটার। আমার মনে আছে, ‘যাদবপুর জার্নাল অব কম্পারেটিভ লিটারেচার’-এর একটি প্রবন্ধ আমি প্রায় এক ওয়ার্কশপ প্রথায় ওই বিভাগের দাক্ষিণ্যে ছাপার চেষ্টা করেছিলুম। আমাকে ছাত্র পেয়ে যাঁকে ডঃ সেন ‘মেকানিক্যাল এঞ্জিনীয়ারিং’ থেকে বের করে ‘প্রিন্টিং’-এর দায়িত্বে নিয়ে এসেছিলেন, সেই অশোক মুখোপাধ্যায় খুব খুশি। মেকানিক্যাল এঞ্জিনীয়ার হলেও রুচি ও মানসতায় তিনি ‘প্রিন্টিং’-এরই যোগ্য লোক। এই বিভাগ যাদবপুরে খুলেছিল ১৯৮৮-তে। আর আজ ২০২২-তে আমার মতো এক কম্প্যুটার-মূর্খ ল্যাপটপে বসে বাংলায় এই নিবন্ধ লিখছি! ডঃ শংকর সেনকে ভবিষ্যদ্‌দ্রষ্টা ছাড়া আর কী বলব!

যাদবপুরের যে এক দ্বিতীয় ক্যাম্পাস আছে তা হয়তো যাদবপুরে বসে সকলের সারাক্ষণ মনে থাকে না। অথচ এই সল্টলেক ক্যাম্পাস ছাড়া এখন যাদবপুর অসম্পূর্ণ। এটা যখন তৈরি হয় তখন ডঃ সেনের উৎসাহের শেষ ছিল না। মাঝে মাঝেই চলে আসতেন, কখনও কখনও আমাদের কাউকে কাউকেও নিয়ে আসতেন। ওঁরই পরিকল্পনা। প্রশস্ত সব ক্লাসঘর, লাইব্রেরি ও পাঠাগার, হস্টেল, খেলার মাঠ। চারটে নতুন এঞ্জিনীয়ারিং বিভাগ এতে উঠে এল - ‘ইনস্ট্রুমেন্টেশন’ ও ‘প্রিন্টিং’ ছাড়া তাঁর সময়েই শুরু, ‘পাওয়ার প্লান্ট এঞ্জিনীয়ারিং’ ও ‘কনস্ট্রাকশন এঞ্জিনীয়ারিং’। এবং বসল এক ‘হাইড্রলিক্‌স ল্যাবরেটরি’। গড়তে ভালোবাসতেন ডঃ সেন। একবার কোনো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যাদবপুরের চাহিদা পেশ করতে অশোকনাথ বসু ও আমাকে নিয়ে দিল্লিতে ইউজিসি-র দপ্তরে। আরেকবার বালিতে এক ভাস্করের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত প্রতীক, উন্মুক্ত পরিবেশে সংস্থাপনীয় কয়েকটি ছাত্র-ছাত্রী মূর্তি নির্মাণের অনুরোধ জানাতে।

আর্ট্‌সের ডীন হয়ে যখন প্রথম এক্সিক্যুটিভ কাউন্সিলে তাঁর পাশে বসলাম, তিনি বললেন সিগারেটে অরুচি নেই তো, কারণ তিনি মাঝে মাঝেই সিগারেট খাবেন। সভায় আসতেন একটু আগেই, আলোচ্য বিষয়াবলিতে ওয়াকিবহাল হয়ে। আর চমৎকার সম্পর্ক ছিল তাঁর কাউন্সিল-সেক্রেটারি, রেজিস্ট্রার ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তর্ক যে কাউন্সিলে একেবারে উঠত না তা নয়, কিন্তু মীমাংসাও হত। উপাচার্য তথা কাউন্সিল-সভাপতি হিসেবে যে নেতৃত্ব তিনি দিচ্ছিলেন তা ধীরোদাত্ত। দিনগত পাপক্ষয় নয়, যাদবপুরের কল্যাণ ও সেইসঙ্গে অগ্রগতিই যে আমাদের সকলের কাম্য, সে-নিয়ে কোনো সংশয়ের অবকাশ থাকত না কাউন্সিলের কার্যক্রমে। এমনি সপ্তাহের পর সপ্তাহ - এক অভিনব অভিজ্ঞতা আমার মতো দ্বিতীয়-তৃতীয় বেঞ্চির লোকের পক্ষে। তার উপর, একবার ডঃ সেন তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন এক সর্বভারতীয় উপাচার্য সম্মিলনে। গুজরাত বিদ্যাপীঠে। মাত্র এক ডীন, কিন্তু উঠছি বসছি, দু-তিনদিন হলেও, ভারতবর্ষীয় উপাচার্যদের সঙ্গে - সে কি অল্প আয়াসের?

বাদল সরকার যখন যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র হলেন, তখন ডঃ সেন একদিন আমাকে বললেন, সুধীন্দ্র (বাদল সরকারের পোশাকি নাম) তাঁর বি. ই. কলেজের সহপাঠী। সে যে এই বয়সেও পড়ছে তাতে তিনি মুগ্ধ। খুব সোজাসাপ্টা মানুষ ছিলেন তিনি, মুগ্ধ হতে জানতেন। যাদবপুর ছেড়ে চলে গেলেও যাদবপুরকে ভুলে যাননি। বছর তিনেক পরে একবার ওঁর বাড়ি গেছি - তখন আমি প্রবীণতম ডীন হিসেবে, তৎকালীন উপাচার্য প্রতীপ মুখোপাধ্যায়ের অসুস্থতা হেতু তাঁর স্থলে কার্যনির্বাহী - ডঃ সেন বললেন, শুনলাম আপনি নাকি বাসে করে ইউনিভার্সিটি আসছেন, গাড়ি নিচ্ছেন না? আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি যেহেতু কাজ চালাচ্ছি, তাই ইউনিভার্সিটি এসেই তবে উপাচার্যের দায়িত্ব নিতে পারি - তখন রাজভবন বা রাইটার্সে বা অন্য কোথাও যেতে হলে তো অবশ্যই গাড়ি নিই। তবে দিনের কাজ চুকিয়ে যখন বাড়ি ফিরি, তখন আমি আবার আমি - ডীনেরা তো নিজেদের মতোই যাতায়াত করি, তাই না? মানলেন আমার অম্লান দত্তীয় যুক্তি। যুক্তি ও আত্মসম্মান তাঁর কাছে জরুরি ছিল। নইলে তাঁর মন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় দফা শেষ হবার আগেই ইস্তফা দেন?

কিন্তু কাজ থেকে কখনও ইস্তফা দেননি। তাঁর শেষ কর্মস্থল ছিল অরবিন্দ ইনস্টিট্যুট অব কালচার - তার সর্বোচ্চ পরিচালন সমিতি তথা ‘ওয়ার্কিং কমিটি’-র তিনি বর্ষীয়ান সদস্য। আমিও অবসরের পরে ওখানে দু-একবার গেছি, বিশেষ করে ওঁরা যখন আলিপুর বোমার মামলার কিছু কাগজপত্র পেলেন। কিন্তু ডঃ সেনের ইচ্ছে সত্ত্বেও আর নিয়মিত যেতে পারিনি, যেহেতু আমি ততদিনে বিদ্যাসাগর ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছি। গেলে হয়তো আরো একবার তাঁর অফুরান কর্মপ্রাণতার সাক্ষী হতে পারতাম।সেই একই শংকর সেন, বি. ই. কলেজের শ্রুতকীর্তি অধ্যাপক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উপাচার্য, পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা নিবারক বিদ্যুৎমন্ত্রী। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।


(অনসূয়া চক্রবর্তীর সৌজন্যে)