আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২২ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৯

প্রবন্ধ

রবীন্দ্রসঙ্গীত-কথা

সুগত ত্রিপাঠী


রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছেন প্রায় দু'হাজার। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সাধারণ মানুষের আগ্রহ তাঁর ওই শ-দুই গানের মধ্যেই (অর্থাৎ, অতি স্বল্পসংখ্যক) সীমাবদ্ধ। কত স্বল্পশ্রুত, প্রায় অশ্রুত অপূর্ব রবীন্দ্রসঙ্গীত যে এখনও লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছে, গুনে শেষ করা যায় না। সে-সব গান নিয়ে একমাত্র সঙ্গীতবেত্তা যাঁরা, গবেষক যাঁরা তাঁরাই চর্চা করেন। তাঁর অসংখ্য বহুশ্রুত সঙ্গীতভাবের ঐশ্বর্যে সমুজ্জ্বল ঠিকই, কিন্তু স্বল্পশ্রুত সঙ্গীতগুলিও অসামান্য, অনেক ক্ষেত্রে বহু-প্রচলিত গানগুলিকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।

আজ বাঙালির ঘরে ঘরে প্রবেশ করেছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। কিন্তু জীবদ্দশায় কবি তাঁর গানের এই মর্যাদা দেখে যেতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে তাঁর গান সেভাবে প্রচারিত ছিল না সাধারণের মধ্যে। অন্যান্য ধরনের তথাকথিত আধুনিক গানের প্রচলনটাই ছিল বেশি। এর একটা সম্ভাব্য কারণ হল - রবীন্দ্রনাথের গানের ভাব বোঝার মতো ক্ষমতা সর্বসাধারণের নেই। আগেও ছিল না, এখনও নেই। তাঁর গান উঁচু তারে বাধা। 'তুমি যে আমার প্রিয়া, আমি যে তোমার' কিংবা 'এখন থেকে তোমায় আমি বলব চিরকাল, আই লভ ইউ' বললে একজন সাধারণ মানুষ চট করে গানের ভাব বুঝতে পেরে যাচ্ছেন। কিন্তু যখন সেই লোকের কানে পড়ছে, 'আমার মন চেয়ে রয় মনে মনে হেরে মাধুরী। নয়ন আমার কাঙাল হয়ে মরে না ঘুরি' অথবা 'না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, ত্যাগিলে আসে হাতে'-র ভাব বুঝতে তাঁর মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা। অথচ উভয়ই প্রেমের গান। কিন্তু কী দুস্তর তফাত ! রবীন্দ্রনাথের এ-রকম অসংখ্য প্রেমের গান আছে, সেখানে প্রেম, বিরহ, ভালোবাসা, আমি, তুমি - ইত্যাদি যে-সব শব্দ প্রেম-সম্পর্কিত বলে প্রচলিত, তার চিহ্নমাত্র নেই। যে দৃষ্টিতে তিনি প্রেমকে দেখেছেন, সেখানে এ-সব শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজন তাঁর হয়নি। তথাপি প্রেমের সহস্র দিক তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন। 'বনে যদি ফুটল কুসুম নেই কেন সেই পাখি' - এখানে 'কুসুম' এবং 'পাখি'-র তাৎপর্য নানান জন নানান রকম করতে পারেন। কারুর কাছে এ প্রেমের কুসুম, কারুর কাছে অন্য কিছু। 'পাখি'-র অর্থ একজন করবেন, প্রেমাস্পদ। অন্য কেউ অন্য কোনও কিছু। অথবা, এই গানটির কথা যদি বলা যায়, 'নীলাঞ্জন ছায়া, প্রফুল্ল কদম্ব বন' - না-জানলে একে প্রেমের গান হিসেবে নির্ণয় করাই দুঃসাধ্য। যাই হোক, বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ এ-সব গান শুনে অর্থ সহজে বুঝতে পারবেন না।

একই কথা বলা যায় রবীন্দ্রনাথের 'পূজা' পর্যায়ের গানগুলি সম্পর্কে। প্রচলিত অর্থে রবীন্দ্রনাথ ভক্ত কিংবা সাধক নন (অবশ্যই ঈশ্বরভক্ত, অধ্যাত্মসাধক-এর কথাই এখানে বলা হচ্ছে)। অথচ তাঁর 'পূজা' পর্যায়ের গানগুলি একটু পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, কী অসামান্য সে-সব সৃষ্টি ! প্রচলিত অর্থে সাধক না-হয়েও এ জাতীয় কাব্য যিনি রচনা করতে পারেন, তাঁর অন্তর যে অধ্যাত্মভাব তথা অতি উচ্চভাবে পরিপূর্ণ ছিল, বলার অপেক্ষা রাখে না। 'তোমার সুরের ধারা ঝরে যেথায় তারি পারে' গানটি এ-ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। খুব করুণভাবে তাঁর 'পূজ্য'-র কাছে তিনি আর্তি জানাচ্ছেন, তাঁর করুণাধারার এক প্রান্তে কি কথকের ঠাঁই হবে? গানের শেষ চরণ - 'হৃদয়ে মোর গানের তারা উঠবে ফুটে সারে সারে'-তেও কবির সেই পরম প্রভুর করুণা জীবনভর বহনের ইঙ্গিতই ফুটে উঠেছে। 'অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ' - কবিকন্ঠে সুলভ এই ব্রহ্মসঙ্গীতটিতে পরমপিতার প্রতি অকুণ্ঠ প্রার্থনা ধ্বনিত হয়েছে অপরূপ রূপে। কিন্তু যা-ই হোক, এ-সব গানকে প্রচলিত ভক্তিসঙ্গীতের ফ্রেম-এ বাঁধানো কঠিন। গানের মাঝে 'মা' কিংবা 'বাবা' অথবা 'হে ভগবান', 'ঈশ্বর' ইত্যাদি শব্দ প্রায় অনুপস্থিত - যা বেশিরভাগ ভক্তিগীতিতে দেখা যায়। তাই অনেকেই এগুলি যে অধ্যাত্মভাব-সমন্বিত গান - তা না-হলেও যে একটা আত্মনিবেদনের ভাব এ-সব গানের প্রাণ - সেটা ধরতে বা বুঝতে পারেন না। সোজা কথায়, খুব উচ্চশিক্ষিত লোকেদের জায়গা এটা। উন্নত মস্তিষ্ক দিয়ে বিচার করলে তবেই এ সঙ্গীতের মর্ম উপলব্ধি সম্ভব।

তাঁর 'স্বদেশ' পর্যায়ের বেশিরভাগ গানেও ভাবের উচ্চকিত প্রকাশ নেই। সবকিছু দুদ্দাড় ভেঙে দেওয়ার আহ্বান নেই। যা বলেছেন তার অভিঘাত তীব্র, কিন্তু ভাব শান্ত। 'প্রকৃতি', 'বিচিত্র', 'আনুষ্ঠানিক' পর্যায়ের সঙ্গীতও তাঁর এই মার্জিত ভাবের অনুসারী। 'এবার অবগুণ্ঠন খোলো' শুনলেই মনে হয় প্রেমের গান, বিশেষত গানটির শেষ চরণ 'বিরহ-মিলনে-গাঁথা নব প্রণয়দোলায় দোলো' - কিন্তু গানটি শরৎ ঋতুর। অর্থাৎ, কবির গান তলিয়ে দেখার দাবি রাখে। 'না গো, এই যে ধুলা আমার না এ'-র মতো উচ্চকোটির গান (গানটি 'বিচিত্র' পর্যায়ভুক্ত) বুঝতে যেমন ক্ষমতার দরকার, একই রকমভাবে 'আনুষ্ঠানিক' পর্যায়ের 'সুধাসাগর তীরে হে' সর্বসাধারণের বোধগম্য হওয়া প্রায়শ অসম্ভব।

অধিকাংশ আধুনিক গানের সুরের মধ্যে যে চটুল ব্যাপারটা আছে, রবীন্দ্রনাথ তাকে বর্জন করেছেন। অথচ সেই অর্থে দেখতে গেলে - অর্থাৎ সময়কাল বিচার করলে - তাঁর গানও তো আধুনিকই। রবীন্দ্রনাথ যখন গান লিখছেন, তখন আরও অনেকেই গান লিখছেন - তাঁদের মধ্যে অনেকেরই গান এখনও পর্যন্ত 'আধুনিক গান' হিসেবেই পরিচিত। রবি ঠাকুরের গান শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নয়, আবার পুরোপুরি লঘুসঙ্গীত নয়; তাঁর গান 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' - যার সংজ্ঞা একশো ভাগ নিরূপণ করা দুঃসাধ্য। অথচ তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, লোকসঙ্গীত, বাউল, কীর্তন, প্রচলিত সুর, পাশ্চাত্য সুর - সব নিয়েছেন। কিন্তু মিশ্রণ তাঁর নিজস্ব। যেমন তিনি কাব্য-জাদুকর, তেমন সুর-জাদুকর। এ জাদু ধোকা লাগায় না, মানুষকে পরিপূর্ণ করে। কিন্তু সেই পরিপূর্ণতা উপলব্ধি কিংবা গ্রহণের মানসিক ধৃতি সবার নেই। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর অনেকের কাছে 'একঘেয়ে', 'প্যানপ্যানে'।

রবীন্দ্রনাথ যে সময় সৃষ্টিতে নিমগ্ন, তখন এবং তার আগেও গীতিকবিতার অভাব ছিল না, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার প্রকাশ ছিল অমার্জিত। অমার্জিত অর্থে, ভাবের প্রকাশ হত না-রেখেঢেকে, সপাটে। আবেগের বাড়াবাড়ি বহুক্ষেত্রে প্রকট, যা কাব্যের সুষমাকে বিনষ্ট করে। মোট কথা, ঠিক সুস্থ রুচিসম্পন্ন কাব্য বলতে যা বোঝায়, সেগুলি তা ছিল না। এইখানে রবীন্দ্রনাথ যুগান্ত আনলেন। গানে তিনি আনয়ন করলেন অপরূপ মাধুর্য। ভাবের প্রকাশ হল নিয়ন্ত্রিত, বহুক্ষেত্রে আশ্রয় নিলেন রূপকের, সুরে এল বৈচিত্র্য। সর্বোপরি কবির অপরূপ কাব্যভাষা তো আছেই। কবি দিলীপকুমার রায়কে একবার বলেছিলেন, 'যারা রস-রূপের লাবণ্যে মজে জগতে তাদের সংখ্যা অল্প, যারা বাহাদুরিতে ভোলে তাদের সংখ্যাই বেশি।' ('সংগীতচিন্তা' গ্রন্থ) রবীন্দ্রসঙ্গীত আদ্যন্ত কবির এই উক্তিতে বর্ণিত প্রথম দলের সদস্য। রস-রূপের লাবণ্য যাঁরা উপলব্ধি করতে পারেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁদের জন্য। ঠিক এই কারণেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের যথার্থ বোদ্ধা, যথার্থ ভালোবাসার লোক এখনও কম। অনেকেই নিজেকে 'কালচারাল' প্রমাণ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় ভালো না-লাগলেও রবীন্দ্রসঙ্গীত জোর করে শোনেন সর্বসমক্ষে। বাড়ি ফিরেই তিনি রাবিশ টিভি-সিরিয়ালে নিমগ্ন হন। কোথা থেকে বাঙালি যেন আবিষ্কার করেছে, রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাটা 'সংস্কৃতি' বা 'কালচার' (নাকি 'কলচর')-এর পরিচায়ক। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাশীল নয়, এ-রকম মানুষের এই মনোভাব দেখলে বিরক্ত হতেন। সর্বপ্রকার ভণ্ডামির বিরোধী ছিলেন তিনি। বহু প্রথিতযশা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর মধ্যেও একই ব্যাপার দেখতে পাওয়া যায়। আজন্ম শান্তিনিকেতনে লালিত-শিক্ষিত, কিন্তু রবীন্দ্র-আদর্শের প্রতি তাঁদের আন্তরিক আগ্রহ, শ্রদ্ধাবোধ নেই। কোনও অনুষ্ঠানে কেউ শিল্পীর শাড়ির প্রশংসা করছে, তাই নিয়েই তিনি উচ্ছল; গান সম্পর্কে কথাবার্তা পেছনে পড়ে যাচ্ছে। গানের ভাব বুঝেও গাননা অধিকাংশ শিল্পী। স্টিরিওটাইপ (অথবা, যন্ত্রের মতো) গেয়ে যান। ফলে গান নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে।

শান্তিদেব ঘোষের রেকর্ড শুনলে বোঝা যায়, কতখানি তাঁর নিষ্ঠা, নিবিষ্টতা। প্রতিটি বাণীর অর্থ অনুধাবন করে গাইছেন। রবীন্দ্র-গানের বাণী সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। গভীর অর্থবহ সে-সব বাণী কেউ যদি শুদ্ধভাবে, সঠিকভাবে উচ্চারণ না-করেন, সে-ক্ষেত্রে গানে প্রাণপ্রতিষ্ঠা কী করে হবে? ইদানীংকালের শিল্পীদের ভালো করে গান শেখার ধৈর্য নেই। দীর্ঘকালীন সাধনার পথে যেতে তাঁরা অরাজী। চটজলদি খ্যাতিমান হওয়ার পেছনে ছুটছেন। 'ধর তক্তা, মার পেরেক' - এই নীতি এখন। ফলে তাঁরা (ইদানীংকালের শিল্পীরা) হুমহাম-ধুমধাম* গান যেভাবে পরিবেশন করেন, সেই একই ফ্রেমে ফেলছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতকে। জানেন, দু'চারটে রবীন্দ্রসঙ্গীত না-গাইলে 'জাতে ওঠা' যাবে না। ফলশ্রুতিতে সর্বনাশ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টির। যতদিন রবীন্দ্র-গানের সঙ্গীতসত্ত্ব (কপিরাইট) ছিল, ততদিন অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ ছিল। যে যা খুশি তাই করতে পারত না। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে যখন সেই নিয়ম উঠে গেল, কিছু অসভ্য শিল্পী ঝাঁপিয়ে পড়লেন কবির গানের আদ্যশ্রাদ্ধের উদ্দেশে। ক্রমশই রাবণের গুষ্টি বাড়ছে। এঁদের কাছে হঠাৎ 'আমার পরান যাহা চায়' গানটা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল কোনও অজানা কারণে। কতরকম ভাবে বিকৃত করে যে গানটাকে গাওয়া চলছে, শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। এ-ক্ষেত্রেও এসে যাচ্ছে সেই জনপ্রিয়তার তত্ত্ব। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন তাঁর গান সবাই শুনুক, প্রচারিত হোক। কিন্তু সস্তা জনপ্রিয়তা তিনি চাননি কখনওই। কোনও অর্থেই তিনি 'সস্তা' মানুষ ছিলেন না। গান ছিল তাঁর কাছে প্রাণ। রানী চন্দকে বলা তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি এ-ক্ষেত্রে স্মরণীয় - "এত লিখেছি জীবনে যে লজ্জা হয় আমার। এত লেখা উচিত হয়নি... জীবনের আশি বছর অবধি চাষ করেছি অনেক। সব ফসল যে মড়াইতে জমা হবে তা বলতে পারিনে। কিছু ইঁদুরে খাবে। তবুও বাকি থাকবে কিছু।... তবে সবচেয়ে স্থায়ী হবে আমার গান, এটা জোর করে বলতে পারি।" আশি বছরেরও বেশি আগে করা কবির এই ভবিষ্যদ্বাণী কতখানি সফল আজ, ভেবে দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। সেইসঙ্গে আশ্চর্য হতে হয়, কবির গানে পূর্বোক্ত বিকৃতি দেখেও। কিছু অশিক্ষিত গায়ক এবং অশিক্ষিত শ্রোতাদের জন্যই রবীন্দ্রসঙ্গীতের নামে এ-সব অপসঙ্গীতের প্রচার-প্রসার বাড়ছে।

কবির জীবদ্দশাতেই তাঁর গান পরিবর্তিত করে, 'নিজের মতো করে' গাওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। একটি উদাহরণঃ 'আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে' গানটি যেহেতু 'পূজা' পর্যায়ের, সেই হেতু 'ভগবানের গান', অতএব গানের শুরুতে কেউ জুড়ে দিলেন, 'ও দয়াল'। অর্থাৎ গানটি দাঁড়াল, 'ও দয়াল, আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে' ! রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, এ তো মহা মুস্কিল! তখন তিনি তাঁর কঠোর শ্রমের ফসলকে ব্যাকরণে বাঁধার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। অর্থাৎ, তাঁর গান শ্রোতার কাছে সেইভাবে যাবে, যে-ভাবে তিনি চান। তবে, আর যাই হোক, জীবদ্দশায় কিংবা প্রয়াণের দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত কবির গান কেউ বিকৃত করে গাইতেন না। কপিরাইট আসার আগেও নয়, পরে তো আর সেটা সম্ভবই হয়নি। কেউ গানকে এদিক-ওদিক করলে 'বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড' সতর্ক করে দিতেন শিল্পীকে। সে কারণেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কেউ বিশেষ কায়দাবাজি করে উঠতে পারেননি। যাঁরা সে-সব করতে চেয়েছেন, বিশ্বভারতী কতিপয় অতি বিখ্যাত সে-সব শিল্পীর গানও অনুমোদন করা বন্ধ করে দিতে দ্বিধা করেননি। রবীন্দ্রনাথের গানে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার চেষ্টা অত্যন্ত অনভিপ্রেত। কেউ যদি 'এক্সপেরিমেন্ট' করতে চান গান নিয়ে, সে-ক্ষেত্রে তিনি নিজের গান কিংবা অন্য যে কারও গান নিয়ে যা খুশি করুন না, কে বাধা দিচ্ছে? কিন্তু যেখানে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর সঙ্গীতে কলম চালানোর বিরোধী ছিলেন, সে-ক্ষেত্রে একজন - যিনি গানটির শিল্পী মাত্র - তাঁর, গান ব্যাকরণ না-মেনে গাওয়ার সাহস হয় কী করে? রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার ফলে এর সঙ্গে বিভিন্ন পাশ্চাত্য উৎকট বাদ্যযন্ত্র, গানের মধ্যে সরগম-ভাঁজা, কুলালা-ফুলালা... অদ্ভুত সব শব্দ ঢুকিয়ে দেওয়া - যা খুশি তাই চলছে। এখন পরবর্তী প্রজন্ম যদি একেই 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' বলে ভাবে, সেটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে যেমন অপমান তেমনই ক্ষতি। অথচ পাশ্চাত্য সুরকেও, বাদ্যযন্ত্রকেও কী সুন্দর ভাবে ব্যবহার করা যায়, তা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া 'ফুলে ফুলে ঢ'লে ঢ'লে', 'সকলই ফুরালো স্বপনপ্রায়'-এর মতো গানগুলি শুনলে বোঝা যায়। ঢ্যাং-ঢ্যাং করে একটা গিটার বাজালেই পাশ্চাত্য আবহ হয় না। সর্বগ্রাসী এই বাদ্যযন্ত্রের অপব্যবহার রবীন্দ্রসঙ্গীতেরও মাধুর্য নষ্ট করেছে। অথচ এই যন্ত্রেরই সুন্দর ব্যবহার কত অসংখ্য শিল্পী চমৎকারভাবে করেছেন। কিন্তু তাঁরা গিটারসর্বস্ব হয়ে যাননি। আগে গান, পরে বাদ্য। বাদ্য গানের অনুসারী মাত্র। এমনকি কোনও কোনও সঙ্গীতবিদ এ-কথাও বলেন, কণ্ঠই সর্বশ্রেষ্ঠ যন্ত্র। রবীন্দ্রনাথের স্বকন্ঠে যে অল্প সংখ্যক গান পাওয়া যায়, সেগুলিতে বাজনা নামমাত্র, প্রায় নেই বললেই চলে। কবি নিজে গান গেয়েই তো দেখিয়ে দিলেন, কীভাবে তাঁর গান গাইতে হবে। এর বেশি কী চাই? সব কথা তিনি মুখে বলে দেবেন? 'তবু মনে রেখো' অনেকেই গেয়েছেন, কবির মতো হয়েছে কি? ওই আত্মস্থ ভাব অন্যের পক্ষে আনা অসম্ভব, কিন্তু কিছুটা চেষ্টা তো করা যায়। আগেকার শিল্পীরা তবু খানিকটা করতেন। সবাই না হলেও অনেকেই। কিন্তু এখন রবীন্দ্রসঙ্গীতেও 'মার্কেট ধরার' ব্যাপার। তাই প্রায় সমস্ত জনপ্রিয় অথচ অপদার্থ, অখাদ্য গাইয়েরা রবীন্দ্রনাথের গান গাইছেন। ড্রাম, জ্যাজ-সেট, স্প্যানিশ গিটার, কি-বোর্ডস, অক্টোপ্যাড - কী না বাজছে সেখানে। হুলস্থূল কাণ্ড। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে মান্না দে-র কথা। মান্না দে-র কাছে একবার একজন এসে প্রস্তাব দিলেন, "আপনার গানগুলো যদি আমি একটু অন্যরকম করে গাই, আপনার কি আপত্তি আছে? মানে একটু মডার্ন করে?" মান্নাবাবু বললেন, "ব্যাপারটা কী রকম, শোনান।" আগন্তুক শুরু করলেন জগঝম্প বাজনা, সেইসঙ্গে মান্নাবাবুর গান। আঁৎকে উঠেছিলেন শিল্পী ওই মল্লযুদ্ধ শুনে।

রবীন্দ্র-গানের ভাব বুঝে গাইতে গিয়ে কেউ কেউ আবার অনর্থ ঘটিয়েছেন। অর্থাৎ এঁরা গানের ভাবটা একটু বেশিমাত্রায় বুঝে ফেলেছেন। এখন, 'সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায়' গাইতে গিয়ে কেউ যদি নাটক করে ফেলেন, তা হলে তো মুশকিল। 'তুমি কি কেবলই ছবি' কিংবা 'আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে', 'আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন' গাইতে গিয়ে কেউ যদি প্রায় কেঁদে ফেলেন গানে, সেখানে সঙ্গীতের বিকৃতিই ঘটল। ওটা ভাব ফোটানোর সঠিক নিয়ম নয়। কোনও কোনও শিল্পী তা-ই করেছেন। অশিক্ষিত চাটুকার-পরিবৃত তাঁরা ভাবছেন, খুব ভালো হয়েছে। কেউ কেউ এত মৃদু করে দেন গলা, ভাবেন বোধহয় খুব মধুর শোনাচ্ছে; কিন্তু মধুর তো দূরের কথা, গান অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথের 'তুমি যেয়ো না এখনি', 'কেন যামিনী না যেতে জাগালে না' প্রভৃতি গানগুলি অশ্লীল, এ-কথাও একসময় শোনা গেছে। এগুলি নাকি কামবাসনা জর্জরিত গান। যদি তা-ও হয়, প্রকাশভঙ্গিতে তো বিন্দুমাত্র অশালীনতা নেই। 'স্তন'-এর মতো অসামান্য কবিতাও রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। আধুনিক কোনও কবি কি কল্পনাও করতে পারেন বস্তুটিকে এইভাবে চিত্রণের?

একটু আগে একটা বিষয়ের সামান্য উল্লেখ করেছিলাম, সে বিষয়ে কিছু কথা বলি। একশ্রেণীর ওস্তাদ গায়ক উঠেছেন, যাঁরা তাঁদের নিজস্ব সঙ্গীতচর্চার সঙ্গে সঙ্গে, কেন জানা যায় না রবীন্দ্রসঙ্গীতেও মাথা গলিয়েছেন। এঁরা ওস্তাদ, অর্থাৎ মার্গ সঙ্গীতের শিল্পী। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন। হয়তো শখে। ভালো কথা। কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন যে, রবীন্দ্রসঙ্গীতটা কালোয়াতি গানের জায়গা নয়। প্রয়াত এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী এ বিষয়ে অত্যন্ত উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত তথা হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের বিরোধী তো ছিলেনই না, বরং পছন্দ করতেন। কিন্তু নিজের গানে ওস্তাদি মারপ্যাঁচের বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতে, এ তাঁর গানের রসভঙ্গ করবে। এমনকি তাঁর গান যে প্রথমে কাব্য, পরে গান - সে-কথা 'গীতবিতান'-এর 'বিজ্ঞাপন'-এ স্পষ্ট করে দিয়েছেন কবি। এখন ওস্তাদ গায়করা কী করছেন? কিছুদিন আগে এরকম এক 'ওস্তাদ'-এর গাওয়া 'কে বসিলে আজি হৃদয়াসনে' শুনছিলাম। আর যাই হোক, গানটি রবীন্দ্রনাথের গান বলে মনে হওয়া ভয়ানক দুঃসাধ্য। পরে একই গান কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় শুনে পাপস্খলন করেছিলাম।

আসলে সঙ্গীতজ্ঞ হওয়া আর কাব্যজ্ঞ হওয়া এক নয়। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জগৎ। গুলিয়ে ফেললে চলবে না। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে কথা গৌণ, বহু ক্ষেত্রে নামমাত্র; রাগরাগিণীর আলাপ-বিস্তার-তান ইত্যাদি-ই সেখানে মুখ্য। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতে কী হয়? "হিন্দুস্থানী গানের মত বাংলার গান শুধু সুরের খেলা নয়, বাংলার গান ভাবেরও ব্যাঞ্জনা। বাংলা গান শুধু সুরের অলস রেখার আলপনা নয়, রসাত্মক বাক্যেরও লীলাভূমি। বাংলার কীর্তন, পদাবলী, রামপ্রসাদী, লোকসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত - এগুলি বিভিন্ন যুগে সৃষ্টি হলেও এসবগুলির মধ্যে গান সম্বন্ধে একটি বিশেষ ধারণার নিঃসংশয় প্রমাণ আছে। সেই বিশেষ ধারণাটি হচ্ছে এই যে, গান শুধু সুরের খেলা নয়, গান রস-সত্তা বাক্যেরও আধার।... গানের (রবীন্দ্রসঙ্গীতের) কথাগুলিকে গানের সুর অবজ্ঞা করে নিজের ঐশ্বর্য প্রকাশ করছে না, কিম্বা কথাগুলি নিজেদের প্রাধান্য ঘোষণা করে সুরকে তাচ্ছিল্য করছে না।" ( 'রবীন্দ্রনাথের গান', সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর) স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান সম্পর্কে বলছেন, "গানকে সরস্বতীর শিকল পরালে চলবে না। সে শিকল তাঁর নিজের বীণার তারে তৈরী হলেও না।... আমার মনে যে সুর জমে ছিল, সে সুর যখন প্রকাশিত হতে চাইলে তখন কথার সঙ্গে গলাগলি করে সে দেখা দিল।" ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, "...অন্যভাবে বলতে গেলে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের নতুন রাগগুলোকে ধরতে হবে ঠাকুর-টোড়ী, ঠাকুর-ভৈরবী, ঠাকুর-পূরবী। কিন্তু মূলে সেগুলো টোড়ী, ভৈরবী এবং পূরবীই। তাই রবীন্দ্রনাথকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের যথার্থ অনুগামী বলা যেতে পারে। অথচ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থেকে তাঁর গানের স্বাতন্ত্র্যও অনেক।" অর্থাৎ, রবীন্দ্রকাব্যের যথার্থ রসজ্ঞ ছাড়া তাঁর গান বিশুদ্ধ তথা সঠিকভাবে গাওয়া অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী সুগভীর অর্থ বহন করে - যে কথা আগেই বলা হয়েছে। অতলস্পর্শী তার তাৎপর্য। সেই বিষয়ে সুশিক্ষিত না-হয়ে তাঁর গান গাইতে আসা বাতুলতা। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বহু বড় বড় শিল্পীর মধ্যে এই খামতি দেখা যায়। তাই তাঁদের গাওয়া 'রবীন্দ্রসঙ্গীত'-এ প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয় না, নিজের গলার কেরামতি দেখাতেই তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এর চেয়ে পাড়ার অনুষ্ঠানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করে, তা অনেক মধুময়। কারণ তারা গানটা গানের মতো করে গায়। সেভাবেই তাদের শেখানো হয়।

বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ড নিয়ে কিছু সমালোচনাও অবশ্য আছে। তাঁরা অতিমাত্রায় কড়াকড়িতে বিশ্বাসী। ফলে যতদিন কপিরাইট ছিল, অনেক প্রথিতযশা শিল্পী রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে চাননি।

রবীন্দ্রনাথ একবার মন্তব্য করেছিলেন, "আজকালকার অনেক রেডিয়ো গায়কও অহংকার করে বলে থাকেন তাঁরা আমার গানের উন্নতি করে থাকেন। মনে মনে বলি পরের গানের উন্নতি-সাধনে প্রতিভার অপব্যয় না করে নিজের গানের রচনায় মন দিলে তাঁরা ধন্য হতে পারেন। সংসারে যদি উপদ্রব করতেই হয় তবে হিটলার প্রভৃতির ন্যায় নিজের নামের জোরে করাই ভালো।" ('সংগীতচিন্তা' গ্ৰন্থ, শ্রী জানকীনাথ বসুকে লেখা পত্র) অনেকটা একই রকম কথা বলা যায় রবীন্দ্রসঙ্গীতকে যাঁরা সিনেমায় ব্যবহার করেছেন এবং জনপ্রিয় করে তুলেছেন বলে দাবি করেন, তাঁদের সম্পর্কে। রবীন্দ্রসঙ্গীত স্বপ্রকাশ, সূর্যের মতো। তার দু-খানা পা এতই সবল, তৃতীয় পায়ের খোঁজ করতে লাগে না। বরং বহু ক্ষেত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে সিনেমায় ব্যবহার করতে গিয়ে 'সিনেমার রবীন্দ্রসঙ্গীত' বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতিখ্যাত, হয়তো-বা সর্বাধিক খ্যাত 'আনন্দধারা বহিছে ভুবনে' গানটির দু'রকম ভার্সন (গায়ন) শুনলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যাবে। বম্বের অতিখ্যাত দুই শিল্পীও একসময় একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট বাজারে ছেড়ে আসর মাত করে দিয়েছিলেন।

একজন স্রষ্টার সব সৃষ্টি যেমন সমমানের হয় না, রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও সে কথা সত্যি। অন্ধ রবীন্দ্রপ্রেম রবীন্দ্রনাথকে সম্মানিত করে না, রবীন্দ্রনাথকে ঝগড়ার বস্তুতে পরিণত করে। সকলেই জানেন, রবীন্দ্রনাথই রবীন্দ্রনাথের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাতা। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের সর্বশ্রেষ্ঠ সমালোচকও বটে। কবি অনেক জায়গায় নিজেকে নির্মমভাবে সমালোচনা করেছেন। সেই মানসিক উদারতার অভাব তাঁর কোনও দিন হয়নি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য 'সঞ্চয়িতা' গ্রন্থটির 'ভূমিকা' অংশের কিছু বক্তব্য - "মনে আছে কোনো-এক প্রবন্ধে আমার গানের সমালোচনায় এমন-সকল গানকে আমার কবিত্বের পঙ্গুতার দৃষ্টান্ত-স্বরূপে লেখক উদ্ধৃত করেছিলেন, যেগুলি ছাপার বইয়ে প্রশ্রয় পেয়ে আমাকে অনেক দিন থেকে লজ্জা দিয়ে এসেছে। সেগুলি অপরিণত মনের প্রকাশ অপরিণত ভাষায়।" কবি-সৃষ্ট এমন কিছু গান আছে, যা বিরাট কোনও উচ্চভাব প্রকাশ করে না। কিছু গানের সুরও সাদামাটা। এরকমই কয়েকটি গান - 'তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে', 'তোমার কাছে এ বর মাগি', 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে', 'মাটির প্রদীপখানি আছে মাটির ঘরের কোলে', 'এসো এসো হে তৃষ্ণার জল', 'দারুণ অগ্নিবাণে রে', 'মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি', 'এসো শ্যামল সুন্দর', 'সে আমার গোপন কথা', ' ভালোবাসি, ভালোবাসি', 'মম যৌবন নিকুঞ্জে গাহে পাখি' ইত্যাদি। এ-সব গানে বিরাট কিছু জীবনসত্যের প্রকাশ দেখা যায়নি। একই রকম ভাবে কিছু গানের সুর আহামরি নয়; 'কী গাব আমি, কী শুনাব', 'হে মাধবী, দ্বিধা কেন', 'সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে', 'খরবায়ু বয় বেগে', 'প্রাণ চায় চক্ষু না চায়', 'ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান', 'বঁধু, মিছে রাগ কোরো না', 'আজ খেলা ভাঙার খেলা', 'মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি', 'ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল', 'পুরানো সেই দিনের কথা' - এ-রকমই কয়েকটি গান।

রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি তথা ব্যক্তিচরিত্রে কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা বড় কম হয়নি। কিন্তু তাঁর জন্মের দেড় শতাব্দী এবং প্রয়াণের পরে আটটি দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও তাঁর প্রাসঙ্গিকতা আজও অমলিন। ছেঁদো লোকেদের এঁদো কথা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। বস্তুত রবীন্দ্রনাথ সেই বিরল মহামানবদের একজন, যাঁকে সমালোচনার জন্য আর একটা রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজন। তাঁর কাজকর্মের গতিপ্রকৃতির উচিত-অনুচিত নির্ধারণ সাধারণ মানুষের বোধবুদ্ধির প্রায় বাইরে। রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ জন্মায়। একজন বলেছিলেন, "...যেমন ধরুন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়লে বোঝা যায়, যে লোকটা আমাদের চেয়ে অন্তত এক হাজার গুণ বেশি বুদ্ধিমান।" এই 'একজন' - শম্ভু মিত্র; যিনি আমাদের চেয়ে অন্তত একশো গুণ বেশি বুদ্ধিমান। প্রসঙ্গত উল্লেখ করি শরৎচন্দ্রের অমর উক্তি, "উনি (রবীন্দ্রনাথ) লেখেন আমাদের জন্য, আর আমরা লিখি তোমাদের (সাধারণ পাঠক/মানুষ) জন্য।"

পরিশেষে, রবীন্দ্রসঙ্গীত-রত্নাকর (তথা সমগ্র রবীন্দ্র-সৃষ্টি) থেকে রত্ন আহরণের জন্য ডুবুরিকে আন্তরিকতার সঙ্গে সুশিক্ষিত হতে হবে। নচেৎ জলের উপরিভাগেই থাকবে তার অবস্থান। রত্ন-আহরণ থেকে যাবে চির অধরা।


* অর্থাৎ, লা-রে-লা-প্পা