আরেক রকম ● দশম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ জুন, ২০২২ ● ১-১৫ আষাঢ়, ১৪২৯

প্রবন্ধ

পদ্মা সেতু

গৌতম লাহিড়ী


না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। একটা সেতু গোটা জাতির ভাবাবেগ জাগ্রত করে দিয়েছে। খরস্রোতা পদ্মা নদীর উপরে নির্মিত সেতু। এ যেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ জয়। বাঙালির। বাংলাদেশের। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির আত্মমর্যাদার লড়াই ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি পরাস্ত করেছিল প্রবল শক্তিমান তখনকার পাকিস্তানকে। ৫১ বছর পরে তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পশ্চিমী শক্তির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণ করালেন। নিজের জোরে। বাংলাদেশের মানুষের অকৃপণ যোগদানে আজ সেই স্বপ্ন সত্য। গোটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে প্রাণ সঞ্চার হল তার সুফল পাবে আগামী প্রজন্ম। 'আত্মনির্ভরতা' নিছক স্লোগান নয়। আত্মনির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠল পদ্মা সেতু।

বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে আমরা জনা দশেক সাংবাদিক পদ্মা সেতু দেখতে এলাম। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে আগামী ২৫ জুন, ২০২২। তার আগেই আমন্ত্রিত অতিথিদের পদ্মা সেতু প্রদর্শন। নিঃসন্দেহে বিরল অভিজ্ঞতা।

সকলেই রাজধানী দিল্লির প্রথম সারির সাংবাদিক। এই যুদ্ধ জয়ের কাহিনিতে তাঁরা মুগ্ধ। এটা বাংলাদেশের আর্থিক স্বাধীনতার যুদ্ধ। বিশ্বে বহু সেতু নির্মিত হয়েছে। তার সঙ্গে তেমন হয়তো কাহিনির যোগ নেই। এই পদ্মা সেতুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু ষড়যন্ত্র-রহস্য-চক্রান্ত। রোমহর্ষক বললেও অত্যুক্তি হয় না। আগামী ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে সেতু যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত করবেন। বাংলাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখবেন - দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের সঙ্গে যুক্ত হবে পূর্ব ও উত্তর। বাংলাদেশের অর্থিক বিকাশে এই সেতু যোগ করবে আরও দেড় শতাংশ।

বাংলাদেশের বিস্ময় কক্সবাজারে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। ১২০ মাইল দৈর্ঘ্যের প্রাকৃতিক সৈকত। বিশ্বের দীর্ঘতম। পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রযুক্তির দিক থেকে এমন ইতিহাস তৈরী করেছে তা বিশ্বের কাছে বিস্ময়। প্রায় পাঁচশো স্প্যান খরস্রোতা পদ্মার প্রশস্ত বক্ষে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। দৈর্ঘ্যে ৬ কিলোমিটারের একটু বেশি। এই সময়ে বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। সবথেকে বড় স্তম্ভটির দৈর্ঘ্য ৩৫০ ফুটের গভীরে পদ্মার বুক চিরে। এটাও বিশ্বের মধ্যে প্রথম। গঙ্গা নদীতেও এত বড় স্তম্ভ বসানো হয়নি। এটি দ্বিতল সেতু। উপরিতলায় ছয় লেন সড়ক পথ এবং নীচে রেল পথ। খেয়াল রাখতে হবে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৪০ হাজার ঘনমিটার জল প্রবাহিত হয়।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর সিদ্ধান্ত নেন পদ্মা নদীর উপর অতিকায় সেতু তৈরি করাবেন। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালে প্রাক-যোগ্যতা বরাত আহ্বান করে। বিশ্বব্যাঙ্ক দশ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আচমকা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাঙ্ক প্রকল্পটি বাতিল করে দেয়। বিশ্বব্যাঙ্ক বিবৃতি দিয়ে জানায়, তাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের পদস্থ কর্মী ও কানাডার ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থা 'এসএনসি-লাভলিন' যোগসাজশ করে দুর্নীতি করেছে। বিশ্বব্যাঙ্কের অভিযোগ ছিল যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে জড়িত। হাসিনা সরকার তাঁকে পদত্যাগ করান। তাতেও বিশ্বব্যাঙ্ক ঋণ অনুমোদনে সম্মতি দেয়নি। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন শাখা এবং আদালত সৈয়দ আবুল হোসেনকে নির্দোষ বলে রায় দেয়। কানাডার আদালতেও মামলা হয়। ২০১৭ সালে কানাডার বিচারপতি অয়ান নরধেইমার মামলাটি খারিজ করে দেন এই বলে যে, কানাডার রয়্যাল পুলিশের কাছে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ নেই।

পদত্যাগী মন্ত্রী হোসেন বিবৃতি দিয়ে বলেন, বিশ্বব্যাঙ্ক কায়েমী স্বার্থের চাপে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল। আসল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের উন্নয়নকে ব্যাহত করা। হাসিনা পুত্র জয় ওয়াজেদও বলেন, "যাঁরা অভিযোগ এনেছিলেন তাঁদের উচিত প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা"। একই কথা বলেন আর্থিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান।

বাংলাদেশ সরকার সন্দেহ করে বিরোধী দল এবং পশ্চিমী শক্তি বাংলাদেশ সরকারকে পছন্দ করছে না। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে আবেগপূর্ণ ভাষণে পদ্মা সেতু নির্মাণকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, "ওঁরা আমাদের ভিক্ষা চাইতে বলছে। আমাদের গিনিপিগ করে রাখতে চায়। ওঁদের জানিয়ে দিতে চাই, আমরা কারোর দয়ার উপর নির্ভর করব না। নিজেদের ক্ষমতায় এই সেতু তৈরি করে গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দেবো, ইনশাল্লাহ।" সত্যিই আজ দেখিয়ে দিলেন।

ততদিনে সেতু নির্মাণের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। হাসিনা পদ্মা সেতুর নামে কর বসালেন। বন্ড ছাড়লেন। অনাবাসী বাংলাদেশীরা যোগদান করল এই জাতীয় প্রকল্পে। এখানে বলা দরকার - গোটা বাংলাদেশ এই সেতু নির্মাণে যোগ দিল। ফের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করা হল।

বিশ্বে যতগুলি খরস্রোতা নদীর উপর সেতু রয়েছে তার অধিকাংশই চিনে। এই প্রযুক্তি অন্য দেশের, এমনকি ভারতেরও নেই। প্রথমে চিনের চারটি সংস্থা এগিয়ে আসে। তারা বিওটি অর্থাৎ বিল্ট, অপারেট এন্ড ট্রান্সফার পদ্ধতিতে সেতু নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। সেতু নির্মাণের এমনকি সত্তর শতাংশ ঋণেরও প্রস্তাব দেয়। হাসিনা সরকার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। বরং পাল্টা প্রস্তাব দেয়, চিনা প্রযুক্তি সংস্থা সেতু নির্মাণ করতে পারে। তার সম্পূর্ণ ব্যয় বাংলাদেশ সরকার বহন করবে। শেখ হাসিনা বুঝেছিলেন স্বল্প উন্নত দেশে এই ঋণ, ফাঁদ তৈরি করতে পারে। তাই রাজি হননি। যে কারণে নিকট প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও ভারত এতে কোনো পরোক্ষ আপত্তি তোলেনি।

শেষ পর্যন্ত চিনের 'মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি'কে ২০১৪ সালের ১৭ জুন সেতু নির্মাণের বরাত দেওয়া হয়। প্রকৃত কাজ শুরু হয় নভেম্বর মাসে। ঠিক আট বছর পর সেতুটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। সেতু নির্মাণের মধ্যেই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারপতি লু'ইস গ্যাব্রিয়েল মোরেনো ওকাম্পো সেতু নির্মাণের দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত শুরু করেন এবং তিন উচ্চপদস্থ অফিসারকে দোষী সাব্যস্ত করেন। যদিও কানাডা আদালত তাঁদের নির্দোষ আখ্যা দেয়।

সেতুর কাজ যখন জোর কদমে চলছে, তখন আচমকা ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়, পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা প্রয়োজন। নইলে সেতু পোক্ত হবে না। বাংলাদেশে রীতিমতো অশান্তি ছড়িয়ে যায়। পুলিশ গ্রেপ্তার করে কয়েকজনকে। তারপর সেতু কর্তৃপক্ষকে বিবৃতি দিয়ে জানাতে হয় - এসব গুজব। গবেষকদের বলা হয় প্রকৃত তথ্য মানুষের সামনে তুলে ধরতে। প্রভাবশালী শক্তি থেকে সামাজিক অসন্তোষের মোকাবিলা করে হাসিনা সরকারকে এগোতে হয়।

পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার ফলে ভারতের বা পশ্চিমবঙ্গের সুবিধা কি? বিশেষ করে কলকাতার। কলকাতা থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য চারশো কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হতো। পদ্মা সেতু দিয়ে গেলে দেড়শো কিলোমিটার কম হয়ে যাবে। অর্থাৎ মাত্র আড়াইশো কিলোমিটার। ছ' ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যাবে। যদি ভারত সরকার কোনো কূটনৈতিক জটিলতা তৈরি না করে। এখন কলকাতা-ঢাকা মৈত্রী এক্সপ্রেস নদিয়া হয়ে গেদে যায়। তারপর সীমান্ত পেরিয়ে দর্শনা স্টেশন। দশ ঘন্টা লাগে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছতে।

পদ্মা সেতুতে রেল পথ চালু হলে কলকাতা থেকে বনগাঁ স্টেশন, সেখান থেকে হরিদাসপুর সীমান্ত দিয়ে বেনাপোল। তারপর যশোর-নড়াইল-ফরিদপুর হয়ে ঢাকা। এটা ২৫০ কিলোমিটার।

এটা কেবলমাত্র কলকাতার সুবিধা নয়। বাংলাদেশের বরিশাল ও খুলনা থেকে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও বিপ্লব আনবে পদ্মা সেতু। এর ফলে বঙ্গোপসাগরের তীরের মঙ্গলা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব একশো কিলোমিটার কম হবে। এই দুই বন্দর ভারতকে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ফলে ভারতের স্থলবন্দী উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির সঙ্গে যোগাযোগ সুগম হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১টি জেলায় শিল্প বিপ্লব দেখা দিতে পারে। এখন ঢাকা থেকে বরিশাল বা খুলনায় পণ্যবাহী ট্রাকের যেতে দু'তিনদিন লেগে যায়। পদ্মা সেতু তৈরি হবার পর একদিনেই যেতে পারবে।

প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনা যমুনার উপরে 'বঙ্গবন্ধু সেতু' নির্মাণ করেছিলেন। তখন উত্তরবঙ্গে কার্যত শিল্প বিপ্লব হয়ে জাতির বিকাশ হারে দুই শতাংশ বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল সেই সেতু। পদ্মা সেতু অর্থনীতিতে তার থেকেও বেশি অবদান করাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমে আরও একটি শিল্প বিপ্লবের মুখে বাংলাদেশ। ঢাকা থেকে যাতায়াতের সময় দশ শতাংশ কম হওয়ায় জেলার অর্থনীতিতে বৃদ্ধি হবে পাঁচ শতাংশেরও বেশি। এটা জাপানি 'জাইকা'র বিশ্লেষণ।

এক সমীক্ষা অনুযায়ী খুলনা-বরিশাল অঞ্চলে দারিদ্রের পরিমাণ জাতীয় গড়ের থেকে দশ শতাংশ বেশি। পদ্মা সেতুর পর এর পরিমাণ কমপক্ষে এক শতাংশের বেশি হারে কমবে। জাতীয় গড়ে কমবে এক শতাংশের কিছু কম। সবমিলিয়ে পদ্মা সেতু গোটা দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চলেছে।