আরেক রকম ● দশম বর্ষ দশম সংখ্যা ● ১৬-৩১ মে, ২০২২ ● ১-১৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

প্রবন্ধ

কবিতার বই ঘিরে পুরস্কারের রাজনীতি

শুভময় মৈত্র


গত কয়েকদিন ধরে তুমুল তর্ক। কবিতার বইয়ের জন্যে বাংলা আকাডেমী অর্থাৎ রাজ্যের দেওয়া একটি পুরস্কার পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এ বিষয়ে যে তর্ক চলছে তাতে দুটি প্রান্তিক মত। একদিকে চরম বিরোধিতা। সেখানে আলোচিত হচ্ছে কাব্যগুণ কম থাকা বা তোষামুদেদের কথা। অন্যদিকে চরম সমর্থন। যেখানে মনে করা হচ্ছে এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সমর্থকেরা অনেকে বলছেন রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসা করতেন। বর্ণমালার এই গোটা বেনীআসহকলা-র মধ্যেও বহু মানুষ আছেন। যারা সম্পূর্ণ পক্ষে বা বিপক্ষে নন। কেউ একটি দিকে ঘেঁষে আছেন। কেউ বা একেবারে মাঝামাঝি। তবে এই ভাবনা পুরোপুরি বাঙালি মধ্যবিত্তের। যারা এই দুর্দিনের বাজারেও স্বচ্ছল। আর আমাদের রাজ্যের (প্রচুর মানুষ দু' টাকা কিলো চালের সুবিধা নেন), দেশের (দিল্লি কিংবা অন্যান্য জায়গায় অনেক নিম্নবিত্ত বাঙালি কাজ করেন) বা গোটা বিশ্বের (উদাহরণ মধ্যপ্রাচ্য, যেখানে এ রাজ্য থেকে যাওয়া বাঙালি শ্রমিক আছেন যথেষ্ট) যে নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া বাঙালি, তাঁদের কাছে এই বিষয়টি পৌঁছনোর কোন সুযোগ বা কারণ নেই। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে এঁদের সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে ভোট রাজনীতিতে আপাতত এর কোনো প্রভাব পড়বে না, এটা সকলেই জানেন। তবে আন্তর্জালে বিরোধীদের চূড়ান্ত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এবং সমর্থকদের প্রশংসা-গর্ববোধের বাইরেও কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষণের জায়গা থেকে যায়। সংবাদ এবং সমাজমাধ্যমে আপাতত বিদ্রূপের ভাগটাই বেশি, যার মধ্যে অনেকেই অদ্ভুত কবিতা প্রসব করছেন প্রতি মুহূর্তে। শুরুতে একটা দুটো পড়তে হয়ত মজাই লাগে। কিন্তু তারপর একটানা উদ্ভট কবিতা পাঠ ক্লিশে হয়ে যায়। আর এই অগভীর তর্কের উৎপাতে খুব স্বাভাবিকভাবেই ঢাকা পড়ে যায় মূল্যবৃদ্ধির মত গুরুতর রাজনৈতিক বিষয়গুলি। সে আক্ষেপ আপাতত মুলতুবী রাখা যাক।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক দিন ধরেই ছবি আঁকেন এবং লেখেন এ কথা সকলেরই জানা। সমর্থকেরা সেই ছবি এবং লেখাকে ভালো মনে করেন। তাঁর বই বিক্রি হয় প্রচুর। একইসঙ্গে তাঁর সমালোচকেরা নিন্দা করেন কড়া ভাষায়। বিপুল মূল্যে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি বিক্রি সংক্রান্ত বিতর্কও সকলের জানা। মনে রাখতে হবে এইসব তীব্র নিন্দা কিন্তু একধরণের বিজ্ঞাপনও বটে। ফলে সেই রাস্তায় মুখ্যমন্ত্রীর প্রকাশিত বইয়ের বিক্রি আরও বাড়াটাই স্বাভাবিক। একটা প্রশ্ন এখানে আসবে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নিজের লেখাকে কিভাবে বিচার করেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর কোনো সরকারি বক্তব্য আমাদের জানা নেই। আর কোনো সাহিত্যিক নিজের লেখা নিয়ে নিজে মজা করছেন এমন উদাহরণ বাংলা সাহিত্যে বিরল। তবে সে উদাহরণ আছে, এবং সেটুকু বাড়ির কাজ হিসেবে পাঠক-পাঠিকাদের দেওয়া থাকল। এটাও মুখ্যমন্ত্রী অবশ্যই জানেন যে তাঁর পারিষদেরা যেভাবে এই লেখার প্রশংসা করেন, তা সাহিত্যগুণের জন্যে যতটা, তার থেকে অনেক বেশি তাঁর মোসাহেবী করার জন্যে। তাঁর কিছু কবিতা পড়ে অবশ্যই শিশুরা মজা পেতে পারে, মজা পেতে পারেন প্রাপ্তবয়স্করাও। কিন্তু যে বিদ্বজ্জন মঞ্চে বসে কিংবা সংবাদমাধ্যমে তাঁকে মহান বলে ঘাড় ঝোঁকালেন, তাঁদের প্রশংসার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। এইখানে আরও একটি প্রশ্ন হল নেত্রী তো খুব সহজেই তাঁর অনুগামীদের নির্দেশ দিতে পারতেন এই ধরণের অগভীর প্রশংসা না করতে। সেটা সম্ভব নয়। তার কারণ আজকের দিনের রাজনীতি ঠিক যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে খুব সুগভীর সাহিত্য বা রাজনীতি আলোচনার ভিত্তিতে তৃণমূল কংগ্রেসের মতো একটি তাৎক্ষণিক কর্মসূচি ভিত্তিক দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এরকম উদাহরণ আরও অনেক আছে। আজকের দিনে তৃণমূল এবং বিজেপির রাজনীতিতে বাংলায় নেতা-নেত্রীদের যে পরিমাণ বিশালাকার ছবি দেখা যায়, তা অবশ্যই আজ থেকে তিরিশ বছর আগে এই রাজ্যে ছিল না। কিন্তু উত্তর বা দক্ষিণ ভারতের অনেক জায়গাতেই এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে জনগণ অবহিত ছিলেন। আজকে তা এ রাজ্যেও উপস্থিত। এর ভালো খারাপ বিচার করবে কে? রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্যে একটি রাজনৈতিক দল বা তাদের নেতা-নেত্রীর কৌশল কি হবে, সেকথা যে বিরোধীদের নীতিকথা দ্বারা নির্ধারিত হবে না তা বলাই বাহুল্য।

এই আলোচনার প্রসঙ্গে খুব বেশি করে বাঙালির শিক্ষাদীক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সেই নিরিখে আজকের দিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। জনৈক অধ্যাপক বা পড়ুয়া আগে কোনো সম্মান পেলে তা নিয়ে যা হইচই হত, আজকের দিনে তার থেকে অনেক বেশি হয়। আগেকার দিনে কোনো বিজ্ঞানী ভালো গবেষণা করলে সেটা অনেকে জানতেই পারতেন না। আজকের দিনে শুধু জানা নয়, তাঁর ছবি দিয়ে পোস্টার, ব্যানার বা বিজ্ঞাপন ছেয়ে থাকে আকাশ। কোনো কোনো সময় তিনি নিজে এমনটা করেন, তবে বেশিটাই করেন তাঁর অনুগামীরা। সম্প্রতি অর্থনীতিতে নোবেলজয়ীর পোস্টার যেভাবে আমাদের শহরকে মুড়িয়ে ফেলেছিল, তাতে দেশে ফেরার সময় প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী ঠিক কি ভেবেছিলেন তা আমাদের অজানা। একজন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে কোনো রাজনৈতিক দল, সকলেই নিজের স্বার্থে সফল এবং ক্ষমতাশালীর প্রশংসা করে নিজের দাম বাড়াতে চান। তৃতীয় বিশ্বের এই অঙ্ক প্রাথমিক স্তরেই শিখে যাই আমরা। এখানে আজকের দিনে কিছুটা প্রযুক্তির সাহায্যও আছে। আগে হাসিমুখ ভাসিয়ে দিয়ে কোনো গবেষকের ছবি ছাপাতে যা খরচ হত, বা যতটা সময় লাগত, প্রযুক্তির উন্নতিতে তা এখন সহজলভ্য। উত্তর সম্পাদকীয় পাতায় যে সব অক্ষর ছাপা হয়, তাতে অনেক সময়েই শোভা পায় লেখকের পাসপোর্ট মাপের ছবি। এটা কি কল্পনা করা যেত আজ থেকে তিরিশ বছর আগে? আজকের দিনে ছাপার অক্ষরে আন্তর্জালে কিংবা বাঁধাই করে বই প্রকাশ যতটা সহজ, পাঁচ দশক আগে তা ছিল কল্পনার অতীত। এ সবই কিছুটা প্রযুক্তির দান, আর বেশিটাই আমাদের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের। সেটা খারাপ কি ভালো, শিক্ষা না অশিক্ষা, তার বিচার করবেন সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালি। তাদের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামী, বিরোধী, এবং মাঝের লম্বা রেখা ধরে রঙমিলান্তি, সব ধরণের মানুষই আছেন। তবে তাঁরা সংখ্যার অনুপাতে কম। এর বাইরে অনেক বড়ো অংশকে অবশ্যই খেটে খেতে হয়। তাঁদের এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করার দায় নেই।

লেখার শেষ অংশে মূলত শাসকের একনায়কতন্ত্রী ভাবনার কথায় আসা যাক। এই আলোচনা পৃথিবীর প্রত্যেক শাসককে নিয়েই কোনো না কোনো সময়ে হয়। মমতা ব্যানার্জি নিজেকেই নিজে পুরস্কার দিলেন, এই সমালোচনা দানা বাঁধছে বারবার। কোথাও কোথাও উল্লেখ করা হচ্ছে মুসোলিনি নাকি একই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের ছোট্ট পরিধিতে রামকৃষ্ণ মিশনের সাধক আর পশ্চিমবঙ্গে কয়েক দশক আগের জনাকয়েক বামপন্থী নেতা-নেত্রী ছাড়া সকলেই কিন্তু পারলে নিজের মূর্তি নিজেই গড়ে ফেলি। একই সূত্রে এই প্রসঙ্গও উঠছে যে আজকাল মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকের কৃতী পড়ুয়াদের উপহার দেওয়া বইয়ের একটা বড়ো অংশই মুখ্যমন্ত্রীর লেখা। স্বাভাবিকভাবেই তুলনা আসবে বামফ্রন্ট রাজত্বের সঙ্গে। তখনও সফল পড়ুয়াদের নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে ডেকে একগাদা বই ধরিয়ে দেওয়া হত। মানতেই হবে যে বঙ্গের অনেক সিপিআই(এম) নেতার লেখা বই সেই সময় প্রকাশকের কাছে জমা থাকলেও তা কখনও উপহারের ডালিতে শোভা পায়নি। সেই জায়গায় আজকের উদাহরণ অবশ্যই মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল সরকারের শিক্ষাদপ্তরের শংসাপত্রে স্বর্ণাক্ষরে লেখা কঠিন। অন্যদিকে এটাও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, বামফ্রন্ট সরকারের উপহার দেওয়া বইগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিতেই পরোক্ষভাবে বামপন্থার সীলমোহর মারা থাকত। আসলে বামপন্থী বা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। তাই সেখানে নিজের লেখা বই না গছিয়ে পূর্বসূরীদের স্মরণ করা যায়। তৃণমূলের মতো একটি নব্য এবং নেত্রীভিত্তিক দলের সে সুযোগ নেই। এই দলটি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর। তিনিই এই দলের গোর্কি, তিনিই গোলওয়ালকর। তাই পুরস্কার পাওয়া থেকে উপহার দেওয়া, এই দুই ক্ষেত্রেই রুচি নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও, দল হিসেবে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার প্রশ্নে কোন ধন্দ নেই। নির্বাচনী রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তৃণমূল কংগ্রেসের মূল্য পুরোপুরি তাদের নেত্রী দ্বারা নির্ধারিত। সুতরাং যে ঘটনা ঘটছে, ব্যঙ্গবিদ্রূপ কিংবা মোসাহেবীর বৃত্ত অতিক্রম করে তার স্বচ্ছ রাজনৈতিক বিশ্লেষণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে তীক্ষ্ণ শ্লেষ নিক্ষেপ আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রমাণ। গণতন্ত্রহীনতার সূচকে আমরা এগোলেও, সেটুকু সাহস এবং স্বাধীনতা জনগণের এখনও আছে। অন্যদিকে এটাও মনে রাখতে হবে যে এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দল যে যে বৈশিষ্ট্য নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতদাতার সমর্থন পেয়ে আসছেন, সেই প্রেক্ষিতে এই পুরস্কার কোন নতুন ইতি বা নেতিবাচক মাত্রা যোগ করে না। রাজনীতির ধারাবৃত্তান্তে তাই এই দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণে আগামীর দিকনির্দেশের কোন ইঙ্গিত নেই। এই পুরস্কারকে মুখ্যমন্ত্রীর সচেতন আত্মপ্রচার হিসেবে ভেবে যে বুদ্ধিজীবী সমাজ সমালোচনা করবেন, তাদেরই একটা অংশ তৃণমূলের সমর্থক হিসেবে রুখে দাঁড়াবেন কবিতার প্রশংসায়। দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নমুখী রাজনীতির দায় নেই এই অন্ত্যমিলের হিসেব রাখার।