আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২৪ ● ১৬-৩১ বৈশাখ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

আনুগত্য, বিদ্রোহ এবং ন্যাট টার্নার

চিরন্তন সরকার


শাসিত জনগণের সঙ্গে শাসকের সম্পর্কের দু'টি মাত্রা - আনুগত্য এবং বিদ্রোহ। সচরাচর আনুগত্যের মাত্রাটিতে ধর্ম প্রগাঢ় মধ্যস্থতা করে। ধর্ম ব্যক্তির নিঃসঙ্গ আধ্যাত্মিক মুক্তির সংকল্পই শুধু নয়, ধর্মের সঙ্গে নিজেদের ঐতিহ্যলালিত সম্পর্ক ঝালিয়ে নিয়ে গোষ্ঠী হিসেবেও শাসিত মানুষ শাসকের সঙ্গে রফা করে। ধর্ম সচরাচর শেখায় সহিষ্ণুতা, সংযম, তিতিক্ষা। ধৈর্য আঁকড়ে ধরে শাসিত জনগণ যখন শাসকের অত্যাচারকে সহনীয় জ্ঞান করতে শেখে, সেই শিক্ষা তারা ধর্মের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক থেকেই গ্রহণ করে, নিজেদের ভবিতব্যকে তখন তারা বিনা দ্বন্দ্বে স্বীকার করে এবং ঈশ্বরের অভিপ্রায় ও পূর্বনির্ধারণ হিসেবে সেই অত্যাচার মেনে নেয়। শাসকও তখন প্রতিষ্ঠিত ধর্মচর্চার এই অভিমুখটি নির্বাধ করতে থাকেন - এই বাঁধা সড়কের সমুদয় বিপত্তি অপসারণ করার ব্যাপারে শাসকের দিক থেকেও নানা উদ্যোগ সম্পন্ন হতে থাকে।

নিজেদের শাসনক্ষমতা অব্যাহত রাখতেই শাসিত জনগণের সঙ্গে ধর্মের সম্পৃক্তির এই ধাঁচাটিকেই শাসকশ্রেণী মজবুত করে তোলে - যাতে আনুগত্যের মাত্রাটিতেই শাসিত জনগণ থিতু থাকেন। কিন্তু যখন নানা কারণে ও উপলক্ষ্যে আনুগত্যের বয়ানে চিড় আসে এবং তার রাজনৈতিক পরিণতিতে শাসিত জনগণ বিদ্রোহের পথে চলে যেতে বাধ্য হন, তখনও তাঁদের সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের সম্পর্ক অটুট থাকতে পারে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে তথা বাংলাদেশে নিম্নকোটির, বিশেষত কৃষকদের রাজনৈতিক চৈতন্যকে ধর্মবোধের নিরিখে বোঝার প্রয়াস করতে গিয়ে 'ইমান ও নিশান' (১৯৯৪)-এ গৌতম ভদ্র দেখেছিলেন, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অস্তিত্ব না থাকায় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের গ্রামসমাজে ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণ ছিল গোষ্ঠীগত ব্যাপার এবং এমন কোনও ধর্মবিশ্বাস ছিল না, যা ক্ষমতার রাজনীতির সংস্পর্শমুক্ত, ফলে দুই বিপরীত মেরু হলেও অচ্ছেদ্য সম্পর্কে জড়িত কৃষকচৈতন্যের আনুগত্য ও বিদ্রোহ ধর্মের কাঠামোর মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হবার সুযোগ খুঁজত।

শাসিত জনগণ যখন বোঝে যে, অত্যাচারী শাসকের ধর্মাধর্মবোধ বিলকুল নষ্ট হয়েছে, তখন যে ধর্ম তাদের কর্তৃত্বকে মানতে শেখায়, সেই ধর্ম থেকেই তারা স্পর্ধার যুক্তি খুঁজে পায়। ফলে বিধিবদ্ধ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ক্ষণেও তারা ধর্মবোধে লিপ্ত - এমন নানা উদাহরণ আছে, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক ইতিহাস-পর্যালোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে যেগুলির অনুধাবন প্রায়শই সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিক্ষোভের সময় শাসকের অবস্থান থেকে নিজেদের মূল্যবোধগতভাবে ছিন্ন করতেও, অর্থাৎ সাংস্কৃতিক স্বভূমি লাভ করতেও ধর্মের সঙ্গে নিজেদের সম্বন্ধ এমনভাবে পুনরুজ্জীবিত করতে হয় শাসিতদের, যা হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে শাসকের ধর্মব্যাখ্যা থেকে পৃথক হয়। সন্ত্রাসের সময় তাই কখনও ধর্মের দুই আলাদা চিহ্ন নিয়ে ব্যাপৃত হতে পারে শাসিত ও শাসক। গৌতম ভদ্র দেখিয়েছেন, ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ফড়েদের চোখরাঙানিকে যুঝতে চেয়ে দেশীয় প্রজা যে ধর্মবোধ অবলম্বন করে, তা প্রথমত সামূহিক বা গোষ্ঠীগত, তার সাথে স্বাধীন ব্যক্তিসত্তার যোগ নেই এবং দ্বিতীয়ত, তা লৌকিকতা-বিবর্জিত, অর্থাৎ ত্রাতা হিসেবে তাদের চৈতন্যের দখল নিতেন স্থানীয় দেবদেবী, পীর, সন্ত বা ইষ্টদেবতা।

যদি শাসকের কাছে ধর্ম নির্দিষ্ট পারিভাষিক অর্থে বা বিধিবদ্ধ ব্যতবস্থায় সংকুচিত থাকে, তাদের পক্ষে শাসিত জনগণের ধর্মবোধের তির্যকতা, দ্ব্যর্থতা ও স্বপ্নপূরণের ব্যঞ্জনা বোঝা দুষ্কর হয়ে ওঠে। এই ধর্মাশ্রিত রাজনীতির মোকাবিলা করা শাসকের পক্ষে কঠিন, কেননা এতে অপ্রত্যাশিতের সম্ভাবনা জাগরুক থাকে - ইহলোক-পরলোকের তফাৎ লুপ্ত করা, মায়া ও বাস্তবের সংক্রমণ সাধ্য করে তোলা এক কল্পময়তার পরিসরে সক্রিয় সম্প্রদায়ের যে ধর্মচেতনা, তা থেকে ওই অপ্রত্যাশিতের আবির্ভাব হতে পারে। ওই অপ্রত্যাশিতই ভিন্ন আঙ্গিকে জেগে উঠেছিল ১৮৩১ সালের আগস্ট মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যখন অকথ্য সামাজিক-আর্থিক বিভেদের কবলে পড়ে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসরা ন্যাট টার্নারের (১৮৮০-১৮৩১) নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। সাদা চামড়ার মালিকদের মারার জন্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাঁরা ৫৫ জনকে নিকেশ করেছিলেন - মহিলা ও শিশুসমেত। ১২ ঘণ্টার ওই বিদ্রোহ দমন করতে কয়েক হাজার সৈন্য নেমেছিল। ন্যাট টার্নারের ফাঁসি হয়। ধরা পড়ার আগে দু-মাস তিনি জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন। টার্নার ছিলেন একনিষ্ঠ বাইবেল-পড়ুয়া। তিনি অন্যান্য ক্রীতদাসদের ধর্মীয় উপদেশ দিতেন। তাঁর বাবা-মাও ছিলেন ক্রীতদাস। সঙ্গীরা তাঁকে 'দ্যু প্রফেট' বলে ডাকত। আনুগত্য নয়, বরং বিদ্রোহের মাত্রাটিতে কাজ করার সময়ও ন্যাট টার্নার ধর্মে সংশ্লিষ্ট ছিলেন - বিদ্রোহের একান্ত রসদ যা, অর্থাৎ প্রেরণা - তা তিনি পেয়েছিলেন ধর্মের অলৌকিকে।

গ্রেপ্তার হবার পর টমাস গ্রে-কে টার্নার যে স্বীকারোক্তি দেন - যা পরে 'দ্য কনফেশনস অব ন্যাট টার্নার' (১৮৩১) নামে প্রকাশ পায় - তাতে টার্নার জানিয়েছিলেনঃ "And about this time I had a vision - and I saw white spirits and black spirits engaged in battle, and the sun was darkened - the thunder rolled in Heavens, and blood flowed in streams - and I heard a voice saying, "Such is your luck, such you are called to see, and let it come rough or smooth, you must surely bear it"...it appeared to me ...that it (the spirit) would then reveal to me the knowledge of the elements, the revolution of the planets, the operation of tides, and changes of the seasons". (পৃ. ৮)। অর্থাৎ, সূর্য অন্ধকারাচ্ছন্ন হবার পর বজ্রপাত হয়েছিল এবং রক্তের নদী বয়ে গিয়েছিল - সাদা ও কালো স্পিরিটরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন - এই স্বপ্নদর্শন হবার পর টার্নার ব্রহ্মাণ্ডের অপরাপর রহস্যগুলি - অর্থাৎ, গ্রহদের আবর্তন, জোয়ারভাঁটা ও ঋতুবদলের রহস্য সম্পর্কে ঐশী বার্তা পাবার কথা চিন্তা করেছিলেন। দাসমালিকদের বিরুদ্ধে যাবার বার্তাটিকে ব্রহ্মাণ্ডের আরও সব নিয়ত ঘটে চলা রূপান্তরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার উপায় তিনি ওই অলৌকিক দর্শনের সূত্রে খুঁজে পান - যা বিদ্রোহের যুক্তি হয়ে ওঠে। আরও বিস্ময়কর সব ব্যাপার মানসপ্রত্যক্ষে কিংবা হয়তো ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষেই অর্জন করেছিলেন টার্নার - দেখেছিলেন, আকাশে পুব থেকে পশ্চিমে ক্রুশবিদ্ধ ত্রাতার দুই হাত ব্যাপ্ত হয়ে আছে, শস্যের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলেন, স্বর্গের শিশির সেখানে রক্তবিন্দু হয়ে আছে, জঙ্গলের গাছের পাতায় চিত্রলেখা দেখতে পেয়েছিলেন - নানা সংখ্যা ও মূর্তি সেসব পাতায় দৃশ্যমান হচ্ছিল - সব রক্তে আঁকা - এর আগে স্বপ্নে যেসব মূর্তি দেখেছিলেন তারাই ফিরে আসছিল গাছের পাতায়। তাঁর মনে হয়েছিল, ওই রক্তের ধারা স্বয়ং খ্রিস্টের, যা পাপীদের ত্রাণ করার জন্য উঁচুতে ওঠার পর ফের শিশির হয়ে নেমে আসছে, তিনি বুঝেছিলেন যে, শেষ বিচারের দিন সমাগতপ্রায়।

এই অলৌকিক দর্শনের কথা যখন টার্নার তাঁর এক শ্বেতাঙ্গ বন্ধুকে জানান, সেই বন্ধুর চামড়া ফেটে রক্ত পড়তে থাকে এবং তার অন্তর্গত বৈকল্যের উপশম হয়। ১৮২৮ সালের ১২ মে টার্নার প্রচন্ড শব্দ শুনতে পান ব্যোমপথে। হোলি গোস্ট আবির্ভূত হয়ে এরপর টার্নারকে জানান যে, সাপকে ইতিমধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, খ্রিস্ট তাঁর জোয়াল নামিয়ে রেখেছেন, এখন টার্নারকেই সেই জোয়াল তুলে নিয়ে সাপের সঙ্গে লড়তে হবে। টার্নার শেষে ফেব্রুয়ারি মাসে সূর্যগ্রহণ হলে তাকে এক পবিত্র সংকেত গণ্য করে সহচরদের কাছে তাঁর শত্রুধ্বংসের প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন।

নৃশংসতার জন্য অভিযুক্ত করা চলে টার্নারদের, তর্ক চালানো যেতে পারে - সংগঠিতভাবে কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের ওপর জুলুম করা আর তারা খেপে গিয়ে প্রভুদের হত্যা করলে - কোনটা বেশি গুরুতর অপরাধ সাব্যস্ত হবে, রক্ষণশীলরা বলতে পারেন, ধর্ম বলতে টার্নার যা বুঝেছিলেন তা আদপে ধর্মই নয়, ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় লালিত প্রগতিবাদীরা বৈজ্ঞানিক ও নিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চার দৃষ্টিকোণ থেকে টার্নারের স্বপ্নদর্শনকে বাতিল করতে পারেন, টার্নারকে ধর্মান্ধও বলা হয়েছে। কিন্তু বিবেচ্য এও যে, টার্নার মনে করেছিলেন তিনি কোনো অন্যায় করেননি এবং গোটা হত্যাকাণ্ডটির পক্ষে তিনি ন্যায়বিচারের উদ্দেশে পরিচালিত তাঁর অলৌকিক প্রত্যক্ষকে অর্থাৎ ঐশী বাণীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস করেছিলেন। ধর্মের সঙ্গে বিদ্রোহের এই সম্পর্ক শাসককে এতোদূর ত্রস্ত করেছিল যে, এরপর উত্তর ক্যারলিনা ও ভার্জিনিয়া অঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গদের ধর্মপ্রচার অথবা ধর্মসভায় যোগদানের ব্যাপারটিকে নিশ্ছিদ্র নজরদারির অধীনে নিয়ে আসা হয়।