আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২৪ ● ১৬-৩১ বৈশাখ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

গৃহস্থালি ব্যয়ের পরিসংখ্যান (২০২২-২৩): বাস্তবে কতটা ভরসাযোগ্য?

শোভিক মুখার্জী


প্রেক্ষাপট

ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশন সাম্প্রতিক হাউসহোল্ড কনজাম্পশন এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচসিইএস), যা গৃহস্থালি ব্যয় সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা, তার কিছু পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। ২০২২-২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সমীক্ষার সারসংক্ষেপ, এক দশকেরও বেশি সময় পর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে, ২০১৭-২০১৮ সালের সমীক্ষার ফলাফলগুলি পরিসংখ্যানের গুণমান সংক্রান্ত সমস্যার কারণ দেখিয়ে সরকার তা প্রকাশ করেনি। যা নিয়ে জলঘোলাও কম হয়নি। এককালে সরকারিভাবে প্রকাশিত পরিসংখ্যানের গুণমান বিষয়ে ভারতের বেশ সুনাম ছিল। অথচ, আজ যে কোনও মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ভরসাযোগ্য পরিসংখ্যানের অভাব।

শুরুতেই বলে রাখা ভালো, সমীক্ষার পদ্ধতিতে পরিবর্তনের কারণে বর্তমান সমীক্ষাকে আগের রাউন্ডের সাথে তুলনা করা উচিত হবে না। তবে অনেক ক্ষেত্রেই, সরকার ২০২২-২০২৩ এবং ২০১১-২০১২ সালের সমীক্ষার মধ্যে একটি তুলনামূলক ছবি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে। এ ব্যাপারে, সাধারণ মানুষের সচেতন হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।

২০২২-২০২৩ সালের সমীক্ষার পরিসংখ্যানের ছবিটি ঠিক কী রকম?

এই সমীক্ষাটিতে দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ এলাকায়, ২০১১-২০১২ সালে ১,৪৩০ টাকা থেকে ২০২২-২০২৩ সালে ৩,৭৩৩ টাকা এবং শহরাঞ্চলে ২,৬৩০ টাকা থেকে ৬,৪৫৯ টাকা বেড়েছে গৃহস্থালি ব্যয়৷ গৃহস্থালি ব্যয় বৃদ্ধিতে যা গিয়ে দাঁড়ায়, ২০১১-২০১২ মূল্যে, গ্রামীণ এলাকায় প্রতি বছর ৩.১ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ২.৭ শতাংশ৷ তবে এর বেশিরভাগই মুদ্রাস্ফীতির কারণে। এছাড়াও, বেশ কিছু আকর্ষণীয় তথ্য উঠে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, পরিবারের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে খাদ্যের ব্যয়ও হ্রাস পেয়েছে। গ্রামীণ এলাকায়, খরচের ঝুড়িতে খাদ্যের অংশ ২০১১-২০১২ সালে ৫২.৯ শতাংশ থেকে ২০২২-২০২৩ সালে ৪৬.৪ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে শহরাঞ্চলে এটি ৪২.৬ শতাংশ থেকে ৩৯.২ শতাংশে নেমে এসেছে। খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে - গ্রামীণ এলাকায় ১০.৭ শতাংশ থেকে ৪.৯ শতাংশে এবং শহরাঞ্চলে ৬.৬ শতাংশ থেকে ৩.৬ শতাংশে নেমে এসেছে৷

পরিবারগুলি এখন ডিম, মাছ, মাংস, দুধ, ফল, সেইসাথে প্রক্রিয়াজাত খাবারের মতো পুষ্টিকর জিনিসের জন্য ব্যয়ের একটি বড় অংশ বরাদ্দ করছে। পানীয় এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের (বেভারেজেস এবং প্রসেসড ফুড) খরচ এখন খাদ্যশস্য এবং ডাল-এর সম্মিলিত যে খরচ তার চেয়ে বেশি। আর, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য এখন ভোগের ঝুড়িতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ২০২২-২০২৩-এ, পান, তামাক এবং নেশাজাতীয় দ্রব্যে মাথাপিছু মাসিক ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১৪৩ টাকা, যেখানে শিক্ষার জন্য ব্যয় করা হয়েছে ১২৫ টাকা। তবে এটাও বলা দরকার, ব্যয়ের একটি বৃহত্তর অংশ এখনও শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিবহন পরিষেবার খাতের মধ্যে দিয়ে চালিত হচ্ছে।

এবারের সমীক্ষাটি কীভাবে আলাদা?

পদ্ধতিগত দিক থেকে বেশ কয়েকটি জায়গায় আলাদা এবারের সমীক্ষাটি৷ তার মধ্যে, বিশেষ কয়েকটি পার্থক্য তুলে ধরা হল৷ ২০২২-২০২৩ সালে নমুনা পদ্ধতিতে স্ট্র্যাটাম-এর স্তরে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। এর ফলে 'গ্রামীণ' স্তরটি মাত্র দুটি স্তর নিয়ে গঠিত, প্রথমটি, জেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্বের গ্রামগুলি নিয়ে গঠিত এবং বাকিগুলি অন্যান্য স্তরে রয়েছে। 'শহুরে এলাকার' স্তরগুলি জনসংখ্যা এবং সেইসাথে বিত্তশালী অবস্থার উপর ভিত্তি করে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। এছাড়াও, স্তরের শ্রেণিবিন্যাস এখন গ্রামীণ এলাকায় ভোক্তার জমি থাকা বা না থাকা এবং শহরাঞ্চলে ভোক্তার গাড়ি আছে না নেই তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, আগের সমীক্ষার বিপরীতে যেখানে বিভাজনগুলি গ্রামীণ এলাকার জন্য পরিবারের অবস্থা এবং শহরাঞ্চলের জন্য মাসিক মাথাপিছু আয়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, আগের রাউন্ডগুলিতে সমস্ত বস্তুগুলির ক্ষেত্রে ব্যয় নথিভুক্ত করার জন্য একটি একক প্রশ্নাবলী ছিল। নতুন সমীক্ষায় যথাক্রমে খাদ্যসামগ্রী, ভোগ্য এবং পরিষেবা সংক্রান্ত বস্তুগুলির ওপর তিনটি পৃথক সমীক্ষা হয়েছে। তৃতীয়ত, পরিবারগুলিতে একাধিকবার সমীক্ষকেরা এসে পরিদর্শন করেছেন। তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি হিসাবে, এই উভয় পরিবর্তনই স্বাগত কারণ এটি সকলেরই জানা যে একটি একক বৈঠকে দীর্ঘ প্রশ্নাবলী থাকলে তা উত্তরদাতাদের ক্লান্তি ও ধৈর্য্যচ্যুতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় - যার ফলে পরিসংখ্যানের মান খুব একটা ভালো হয় না। সংক্ষিপ্ত প্রশ্নাবলী আরও সুনির্দিষ্টভাবে উত্তর বের করতে সহায়ক। এই রাউন্ড এবং আগের রাউন্ডগুলির মধ্যে শেষ পার্থক্যটি বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে বিনামূল্যে প্রাপ্ত বস্তুগুলি বা খাওয়ার বস্তুগুলির যোজিত মূল্যের সাথে সম্পর্কিত। এই জিনিসগুলির মধ্যে রয়েছে চাল, ডাল, গম থেকে শুরু করে জুতো, ল্যাপটপ এবং মোটরসাইকেল। ইউনিট-স্তরের দাম এবং পরিমাণ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত এর বৈধতা মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়।

দারিদ্র্য ও অসমতাঃ কী বলছে সমীক্ষা?

২০২২-২০২৩ সালে গড় সর্বভারতীয় শহুরে এলাকার মাসিক মাথাপিছু ব্যয় ৬,৪৫৯ টাকা, গ্রামীণ এলাকার তুলনায় প্রায় ৭২ শতাংশ বেশি (৩,৭৭৩ টাকা)। ২০১১-২০১২ সালে সংশ্লিষ্ট সংখ্যা ছিল ৮৪ শতাংশ - এটি গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়। একটি ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। ‘গ্রামীণ’ - ‘শহুরে’ মূল্যের পার্থক্য যা ক্রমাগত ওঠানামা করে তা কিন্তু বিবেচনা করা হয়নি। সরকার এটিকে ক্রমবর্ধমান আয়, বৈষম্যে হ্রাস এবং দারিদ্র্যের স্তরে তীব্র স্খলনের একটি সংকেত হিসাবে চিহ্নিত করতে চেয়েছে। এই ১১ বছর সময়কালে গ্রামীণ ব্যয়ের যৌগিক বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৩.৫ শতাংশ, শহরের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ - যা কিন্তু এই সময়ের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি এবং জিডিপি বৃদ্ধির হারের চেয়ে অনেক কম।

এই পরিসংখ্যানগুলি দাবি করছে যে, ভারতের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশেরও কম জনগণ দারিদ্রসীমার নীচে অবস্থান করছে। যাইহোক, রিপোর্টে দারিদ্র্য দূরীকরণের কোনও উল্লেখ নেই। এছাড়াও, এই সমীক্ষা দ্বারা প্রদত্ত কোন দারিদ্র্যরেখা নেই। তাহলে প্রশ্ন হল, কীসের ভিত্তিতে এটি দাবি করা হল যে এত কম সংখ্যক জনগণ দারিদ্রসীমার নীচে অবস্থিত? একমাত্র পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টটিই এর উত্তর দিতে পারে।

জিডিপি-র নিরিখে ভারত এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, ভারতে লোকসংখ্যা এত বেশি হওয়ার কারণে দেশে মাথাপিছু আয় অত্যন্ত কম। মাথায় রাখা দরকার জিডিপির পূর্ণমূল্যর সাথে মাথাপিছু জিডিপির বিচার করা প্রয়োজন। এরই সাথে অনেকে বলেন গরিব মানুষদের আয় ঠিকমতো মাপা হচ্ছেনা। কথাটা ঠিকই যে অসংগঠিত ক্ষেত্রে রোজগারের ভাল হিসাবপত্র কোনও দিনই করা হয় না। তারড় তাবড় অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, চরম দারিদ্র্যের উপস্থিতিও এই দেশে বর্তমান। মানবোন্নয়ন সূচক, ক্ষুধা সূচকের মতো রিপোর্টে সেই ছবি স্পষ্ট। তাহলে দরিদ্রের আয়ের সঠিক হিসাব হলেও খামতির পরিমাণের সঠিক হিসাব জনসমক্ষে তুলে ধরার দায়িত্ব সরকারেরই। ফুটপাতে যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁদের ক্রয় ও সঞ্চয় ক্ষমতার সঠিক পরিমাপ হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে মাথাপিছু আয়ের সঠিক হিসাব হবে না। ক্রমবর্ধমান আর্থিক অসাম্যের নীচের দিকে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের জীবনে এই অসাম্য কী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তারও যথাযথ পরিসংখ্যান প্রয়োজন। তাই, শুধুমাত্র বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাফল্যের পাশাপাশি এইসকল বিষয়গুলিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

সংকুচিত বৈষম্য সহ অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ব্যাপকভিত্তিক হওয়ার বিষয়ে নীতি আয়োগের দাবি শ্রম বাজারের ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া উচিত। শ্রমজীবী দরিদ্রের সংখ্যা এবং প্রকৃত মজুরি হ্রাস ভারতে শ্রমবাজারের পরিস্থিতি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে যে ভারত তার দারিদ্র্যের অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। ইতিপূর্বে যেমন আলোচিত হয়েছে, ভারতে চরম দারিদ্র্য আর নেই, সরকারের দাবি অনুযায়ী। দেশের মাথাপিছু আয় এত কম হওয়া সত্ত্বেও তরতর করে দারিদ্রের হার কমছে কেন, কীভাবে - সেটা যথাযথ তত্ত্ব ও তথ্য ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠা করার দায় সরকারেরই। তা না হলে, ব্যাপারটা খেলো হয়ে যাবে।

উপসংহার

যেমনটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এই রাউন্ডে তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি আগের তুলনায় অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। সমীক্ষায় যখন সংগ্রহের পদ্ধতি এবং প্রশ্নাবলী পরিবর্তিত হয়, তখন প্রতিক্রিয়াগুলি তুলনাযোগ্য নয়। এইটা বিশেষ করে মাথায় রাখা দরকার। এক্ষেত্রে যতটুকু তুলনা প্রয়োজন, ততটুকু-র ক্ষেত্রেও বোধহয় একটু তাড়াহুড়ো করা হয়ে যাচ্ছে যেখানে পুরো পরিসংখ্যান এখনও প্রকাশিত হয়নি। অর্থনীতির বৈচিত্র্য এবং বৃদ্ধির সাথে সাথে খাওয়ার অভ্যাস পরিবর্তিত হওয়া স্বাভাবিক এবং খুব পরিষ্কারভাবেই এই সমীক্ষায় আমরা তার প্রমাণ পাচ্ছি। এই সমীক্ষার প্রকাশিত পরিসংখ্যান দেশের যেমন পরিসংখ্যানের শূন্যতা পূরণের ক্ষেত্রে সাধুবাদ জানানোর মতো একটি প্রচেষ্টা, তেমনই, পরিসংখ্যান তুলনার ক্ষেত্রে আপাতত পূর্ববর্তী রাউন্ডগুলির সাথে কিন্তু সেতুবন্ধন স্থাপনে ব্যর্থ। এখন দেখার, পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টটি আলোচ্য সমস্যাগুলির ওপর আলোকপাত করে এক নির্ভরযোগ্য সূত্র হয়ে উঠতে পারে কিনা।