আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২৪ ● ১৬-৩১ বৈশাখ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

বাষট্টির স্মৃতি বাষট্টি বছর বাদে

সৌরীন ভট্টাচার্য


নয়া দিল্লি, ২১ ফেব্রুয়ারি। 'স্টেট্‌সম্যান নিউজ সার্ভিস' পরিবেশিত এই তারিখ শিরোনামের প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে ভারত ও চীন দু-পক্ষই পূর্ব লাদাখে ‘শান্তি’ ও ‘সুস্থিতি’ বজায় রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছে। আমাদের বিদেশ মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়েছে এই আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল চুশুল-মল্‌দো সীমান্ত আলোচনা কেন্দ্রে। বিদেশ মন্ত্রকের ঘোষণা থেকে আরও জানা যাচ্ছে যে, আগের আলোচনাগুলির ভিত্তিতেই বর্তমান আলোচনা এগোতে পেরেছে। এই সমস্ত আলোচনার মূল লক্ষ্য হল পুর্ব লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারত-চীন সীমান্ত অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি ‘শান্তি’ ও ‘সুস্থিতি’ পুনরুদ্ধারের জন্য জরুরি শর্ত পূরণ করা। বিদেশ মন্ত্রক আরও জানিয়েছে যে দু-পক্ষের মধ্যে আলোচনা বন্ধুত্বপূর্ণ ও সৌহার্দ্যময় পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। বিদেশ মন্ত্রকের বার্তা থেকে এও জানা গেছে যে, আগামীদিনের জন্য দু-পক্ষই সামরিক ও কূটনৈতিক দুই পথেই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে চলবে। ইতিমধ্যে সীমান্ত অঞ্চলে ‘শান্তি’ ও ‘সুস্থিতি’ বজায় রাখা হবে। বর্তমানের ২১-তম আলোচনার আগে ২০-তম রাউণ্ডের আলোচনা হয়েছিল ওই চুশুল-মল্‌দো-র সীমান্তবর্তী আলোচনা কেন্দ্রেই। সে আলোচনারও লক্ষ্য ছিল পূর্ব লাদাখে দু-দেশের সম্পর্কে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা ক্রমশ স্বাভাবিক করে তোলা। বিশতম রাউণ্ডের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২৩-এর অক্টোবরের ৯-১০ তারিখে। দু-দেশই সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তোলার সংকল্পে অটুট ছিল। তার জন্য সামরিক ও কূটনৈতিক দুই পথেই চেষ্টা করা হবে। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এ কথাও বলেছেন যে, চীন সম্বন্ধে ভারতের অবস্থান খুব পরিষ্কার। আমাদের দু-দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই। তবে আমরা নিরন্তর সামরিক ও কূটনৈতিক স্তরে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছি যাতে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তোলা যায়। এবং আমাদের প্রত্যাশা এই যে, কোনোরকমের একটা সমাধানের মতো কোনো অবস্থায় আমরা একদিন পৌঁছব। কূটনৈতিক ভাষার সঙ্গে পরিচিত যে-কোনো মানুষই বুঝবেন বিদেশ মন্ত্রকের তরফে প্রচারিত এই প্রতিবেদনের মর্মকথা। লাদাখ সেক্টরে চীনের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত সংঘর্ষের জট কাটেনি।

আসা যাক পূর্ব সীমান্ত ক্ষেত্রের কথায়। অরুণাচল প্রদেশ। অনুরূপ একটি প্রতিবেদন। তারিখ শিরোনাম ইটানগর, ৯ এপ্রিল, ২০২৪। আমাদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং আমাদের প্রতিবেশী দেশটির প্রতি উদ্দিষ্ট এক তীক্ষ্ণ তিরস্কারে জানিয়ে দিয়েছেন, যে যাই বলুক না কেন, অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই ’অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’, ‘ইজ আন ইন্টিগ্রাল পার্ট অব্‌ ইণ্ডিয়া’, এ কথা আমাদের শুনে শুনে প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। প্রধানত অবশ্য কাশ্মীর সীমান্ত প্রসঙ্গে। সেখানে প্রতিবেশী দেশ বলতে বোঝায় পাকিস্তানকে। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঝাঁঝালো প্রশ্নঃ ভারত যদি অনুরূপ কাজ করত তবে তার ফল কী দাঁড়াত। যদি ভারত চীনের কোনো অঞ্চলের নামকরণ নিজের মতো করে করত? প্রথম প্রশ্নটার এক রকমের উত্তর পাওয়া গিয়েছিল আজ থেকে বাষট্টি বছর আগে। ১৯৬২ সালে।

২০ অক্টোবর, ১৯৬২ থেকে ২০/২১ নভেম্বর, ১৯৬২। মাস খানেকের যুদ্ধ। চীন একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করায় তখনকার মতো যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ওই যুদ্ধে ভারতের পরাজয় এক অর্থে আমাদের রাজনীতিতে নেহরু যুগের অবসানের সূচনা। রাজনাথ সিং-এর পূর্বসূরি তদানীন্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। দু-বছরের মধ্যে জওহরলাল নেহরুর মৃত্যু হয়। যুদ্ধের ক্ষয় ক্ষতির মধ্যে ভারতীয় সৈন্যের ১,৩৮৩ জন মৃত, ৩,৯৬৮ জন বন্দী, আর ১,৬৯৬ জন নিখোঁজ, এরকম খবর পাওয়া যায়। সংখ্যার উপরে জোর দিয়ে লাভ নেই। নানারকম সংখ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়। আমি কমের দিকের সংখ্যা উল্লেখ করলাম। একটা কথা বলাই চলে এই যুদ্ধে ভারতের সামরিক মর্যাদা একেবারে ভূলুণ্ঠিত হয়। চীন শুধু যে একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে তাই না, অধিকৃত অঞ্চলের অনেকটা অংশ ছেড়ে তাদের সৈন্যবাহিনীকে পিছিয়ে নিয়ে যায়। কয়েক দিনের মধ্যে বন্দী সৈন্যদের বমডি লার মধ্য দিয়ে প্রত্যর্পণও করে।

আমাদের বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রীর আলংকারিক প্রশ্নের খানিকটা উত্তর বাষট্টি বছরের পুরোনো ইতিহাসের মধ্যেই আছে। তাঁর এদিনের বক্তব্যে মন্ত্রীমশাই জোর দিয়েছেন এই কথাটার উপরে যে, চীন যতই সেসব অঞ্চলের নাম পরিবর্তন করুক না কেন, অরুণাচল অবশ্যই ভারতের সার্বভৌম অঞ্চলের অন্তর্গত। এই সঙ্গে এক নিশ্বাসে মন্ত্রী একথাও বলেছেন প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে জোরালো সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি এবং ভারত আত্মমর্যাদা রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সন্দেহ হয় ভারতের আত্মমর্যাদায় টান পড়ছে বলে কি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরও সন্দেহ জাগছে। তাঁর কথাকে আক্ষরিক অর্থে নিলে ব্যাপার যা দাঁড়াচ্ছে তা এই রকম - স্থান নাম বদল করায় চীন যা করছে তা করুক, আমরা চীনের সঙ্গে প্রতিবেশীসুলভ জোরালো সম্পর্ক বজায় রেখে যাব এবং আমাদের আত্মমর্যাদা রক্ষায় আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকব। আপাতত রাজনাথ সিং-এর তরফে এই রকম এক দুর্বল কূটনৈতিক বার্তা প্রচার করার দরকার পড়ল কেন বা তার উপলক্ষ্যই বা কী? চীন সম্প্রতি অরুণাচল প্রদেশের তিরিশটি স্থান নামের এক পরিবর্তিত তালিকা প্রকাশ করেছে। তারই উত্তরে এই হল ভারতের কূটনৈতিক প্রতিবাদ। এইসব খবরে আমাদের বাষট্টি বছর আগের স্মৃতি অবশ্যই জেগে উঠছে।

সেবার যুদ্ধের সূত্রপাতে কয়েকটি বড়ো ঘটনার কথা উল্লেখ করা চলে। পটভূমি রচনায় ছিল তিব্বত উত্থান, ১৯৫৯। এই ঘটনার পরে দলাই লামা ভারতে চলে আসেন এবং ভারত তাঁকে কিছু শর্তাধীন কূটনৈতিক আশ্রয় দেয়। সময়টা ছিল সাধারণভাবে 'হিন্দি-চীনি ভাই ভাই'-এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক আবহাওয়া। দলাই লামা তখন থেকে টানা ভারতেই আছেন। প্রথম দিকে ভারত-চীন সম্পর্কে এটা ছিল এক বড়ো ধাক্কা। দু-দেশের সম্পর্কে আজও এটা কাঁটা হয়ে আছে। চীনের 'জিনহুয়া নিউজ এজেন্সি'র বয়ানে গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে তিব্বতের উঁচু শ্রেণির মানুষের নেতৃত্বাধীন সামন্ততান্ত্রিক ক্ষমতাবানেরা আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদীদের সহযোগিতায় চীন থেকে তিব্বতকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে ১৯৫৯-এর ১০ মার্চ এক সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটিত করে। চীনের সরকারি বয়ানে এর সবই দলাই লামা ও তাঁর অনুগামীদের কীর্তি। ১৯৫৯-এর এই উত্থানের কথা বলতে গেলে আরও একটু পিছিয়ে ১৯৫১-র চীন-তিব্বত চুক্তির কথা একটু বলা দরকার। '১৭-দফা চুক্তি' নামে পরিচিত এই দলিল চীন ও তিব্বতের মধ্যে ১৯৫১-তে স্বাক্ষরিত হয়েহিল। এই চুক্তি অনুসারে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি মেনে নিয়েছিল যে তিব্বত যদি মূল চীনের সার্বভৌমত্বের ধাঁচে নিজেকে মানিয়ে নেয়, তাহলে বিনিময়ে চীনও তিব্বতের প্রথাগত সামাজিক ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করবে না এবং দলাই লামার ক্ষমতাও অব্যাহত থাকবে। এইসব চুক্তি দু-পক্ষেই কতদূর পর্যন্ত যথাযথ পালিত হয়েছিল তা নিয়ে প্রশ্ন থাকেই। দলাই লামাও যেসব শর্তে ভারতে আশ্রয় পেয়েছিলেন তার মধ্যে ছিল ভারত ভূখণ্ড থেকে চীনের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশ বা অবস্থান থেকে বিরত থাকতে হবে। এসব শর্ত সবই যে সবসময়ে পালিত হয়েছে তা বলা মুশকিল। তিব্বত সমস্যার পটভূমিতে এল আকসাই চীনের সমস্যা। ১৯৬০-৬২ কালপর্বে দু-দেশের মধ্যে কূটনৈতিক স্তরে অনেক আলোচনা হয়েছিল। শান্তিপূর্ণভাবে আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে সমস্যা মিটিয়ে নেবার ঐকান্তিক চেষ্টাও হয়তো ছিল। কিন্তু সংঘর্ষ এড়ানো যায়নি। ওই কালপর্বে চীনা কূটনৈতিক প্রস্তাব ভারতের তরফে প্রত্যাখ্যানের পরে চীনের আগ্রাসী মনোভাব বৃদ্ধি পায়।

তখনকার আন্তর্জাতিক পরিসরের আরও দুটি ঘটনা এই সীমান্ত সংঘর্ষে নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছিল বলে মনে হয়। ষাটের দশকের এই সময়টাই সেই সময় যখন শুধু 'হিন্দি-চীনি ভাই ভাই' ভাবনায় ধাক্কা লাগছে তাই না। সোভিয়েত-চীনের সম্পর্কেও টানাপোড়েন তৈরি হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের অবনতিতে সোভিয়েতের ভূমিকা নিয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়তো শক্ত। তবে জল্পনা তখনও কিছু ছিল। সংঘর্ষ কালের একটু পরবর্তী ঘটনা। ভবানী ভট্টাচার্যের উপন্যাস 'শ্যাডোজ ফ্রম লাদাখ'। ওই সংঘর্ষের পটভূমিতে রচিত রবীন্দ্র-গান্ধী আদর্শ ও দেশগঠনের ব্রত ইত্যাদি বিষয়ে লেখা এই বই নিয়ে তখনকার সোভিয়েত বিদ্যান মহলের আগ্রহ ও আনুষ্ঠানিক গবেষণা প্রচেষ্টার কূটনৈতিক মাত্রা একেবারে অগ্রাহ্য করার মতো নয়। সব মিলিয়ে বলা চলে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের একমাত্রিক মসৃণতা তখন আস্তে আস্তে ভেঙে যাচ্ছে। সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন শিবিরে ফাটল দেখা দিচ্ছে। এই ফাটলের কি এক আসন্ন প্রকাশ চিহ্ন আমরা দেখতে পাই ষাট-সত্তর দশকের মাওবাদী চিন্তাধারার উত্থানে। পাশ্চাত্যের যুবসমাজও যে-চিন্তায় নিশ্চিতভাবে আন্দোলিত হয়েছিল। কালে কালে এই চিন্তাধারার প্রভাবেই কি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে সোভিয়েত মনোলিথে ভাঙন দেখা দেবে। এই ভাবধারা অনেকদূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে একেবারে ইউরোকমিউনিজমের হাত ছুঁয়ে ফেলবে একদিন।

দ্বিতীয় যে সমস্যার কথা বলতে চাই তা 'কিউবার মিসাইল সংকট' নামে পরিচিত। আমাদের ভারত-চীন যুদ্ধের সমসাময়িক এক দারুণ আন্তর্জাতিক সংকট। ১৯৬২-র ১৬ অক্টোবর থেকে তেরো দিনের এক টানটান উত্তেজনা। ইতিমধ্যে কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর বিপ্লব সংঘটিত হয়ে গেছে। সোভিয়েত আমেরিকার দ্বন্দ্ব তখন স্নায়ুযুদ্ধের তুঙ্গ মুহূর্তে পৌঁছেছে। সোভিয়েত শিবিরের অনুগামী কিউবার যুদ্ধ জাহাজ পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বহন করে ক্যারিবীয় সমুদ্র দিয়ে এগোচ্ছে। ওই তেরো দিন সারা পৃথিবী পারমাণবিক যুদ্ধের উৎকণ্ঠায় দিন গুনেছে। সৌভাগ্যক্রমে সংঘর্ষের পথে না গিয়ে কূটনৈতিক পথেই সমাধান মিলল। কিউবার জাহাজ এক দিন থেমে গেল। আর এগোল না।

আগেই বলেছি ২০ অক্টোবর থেকে মাস খানেক সংঘর্ষের পরে চীন একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেছিল। এই দুই সংকট মুক্তিতে বিশ্ব তখনকার মতো অন্তত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। এই দুই সংকট নিয়ে বারট্রাণ্ড রাসেল বই লিখলেন 'আনার্মড্‌ ভিক্টরি'। সে বই তখন আমাদের ধারণা ছিল এ দেশে ঠিক নিষিদ্ধ হয়নি, তবে রাতারাতি যেন দোকান থেকে উধাও হয়ে গেল। আমরা অবশ্য তার আগেই পড়ে ফেলতে পেরেছিলাম। এ বইয়ে ভারতের যে সমালোচনা ছিল তা আমাদের মনে খুব ধরেছিল। আমরা তখন এসব নিয়ে খুব চেঁচামেচি, তর্কবিতর্ক করতাম। অবশ্যই নেহাত নিজেদের মধ্যে। তা ছাড়া আমাদের মতো চ্যাংড়াদের তখন আর অবকাশই বা কী ছিল। তবে হ্যাঁ, আমাদের এই সব আবোল তাবোলে আমাদের শিক্ষক এবং শিক্ষক স্থানীয় গুরুজন দু-একজনকে পেয়ে গিয়েছিলাম। একটা কথা। কিউবার মিসাইল সংকট আর আমাদের চীন যুদ্ধ, এ দুয়ের মধ্যে খানিক যোগসূত্রের কথাটা আমি তখন ঠিক খেয়াল করতে পারিনি। রাসেলের বইয়ে এই দুই সমস্যার আলোচনাকে আমি তখন অনুরূপ দুটো সংকটের আলোচনা বলেই ভেবেছিলাম। এদের মধ্যে যে এক ধরনের যোগসূত্র ছিল তা যতদিনে বুঝেছি ততদিনে ও বই আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। কাজেই রাসেলের সঙ্গে আর নোট মিলিয়ে নেবার অবকাশ পাইনি।

আকসাই চীনের কথায় ফিরে আসি। ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্তের তিন অংশের মধ্যে এটা পড়ে পশ্চিম অংশে। এই অংশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল হল জম্মু ও কাশ্মীর, জিন জিয়াং এবং তিব্বত। আকসাই চীন এক সুদূর অনাঘ্রাত পার্বত্য অঞ্চল। তিব্বত উত্থানের পরে এই অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে চীন একটা সামরিক সড়ক তৈরি করে তিব্বতের সঙ্গে জিন জিয়াংকে সংযুক্ত করার জন্য। বাষট্টি সালের ভারত-চীন যুদ্ধে এই সড়ক নির্মাণ এক বিতর্কিত পদক্ষেপ। ভারত আপত্তি জানায়। ভারতের বক্তব্য এই অঞ্চল ভারতীয় প্রশাসনের অন্তর্গত লাদাখের অংশ। এই বিন্দু থেকেই সংঘর্ষের সূত্রপাত। এর এক দিকে আছে যাকে বলা হয় ভারতের ‘ফরোয়ার্ড পলিসি’ বা অগ্রসর নীতি। সীমান্তে অন্যদের ঘাঁটি ভেঙে দিতে হবে। আবার চীনের তরফে আছে ওই মিসাইল সংকটের হিসাবনিকাশ। আন্তর্জাতিক মহল ব্যস্ত থাকবে কিউবার সংকট নিয়ে। সেখানে সম্ভাব্য পারমাণবিক যুদ্ধের উৎকণ্ঠা। কাজেই সামরিক অঙ্কের বিচারে আগ্রাসনের এই উপযুক্ত সময়। এবং নেহরু তখন আমেরিকার কাছে সামরিক সাহায্যের প্রত্যাশা করছিলেন। নির্জোট আন্দোলনের নেহরুকে আমেরিকার থেকে দূরে রাখায় সোভিয়েত উৎসাহ কম হবার কথা নয়। কিউবা সংকট অল্প সময়ে মিটে গেল। তাহলে আমেরিকার সাহায্য এখন এসে যেতে পারে। এরকম ভাবনা এক তরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার পিছনে কাজ করে থাকতে পারে, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেউ কেউ এমনও ভাবেন। পশ্চিম দিকে আকসাই চীন আর পূবের দিকে ভূটানের পূর্বে নেফা। চীনের সঙ্গে সংঘর্ষে এই দুটোই তখন ছিল প্রধান বিবাদ ক্ষেত্র। পূবের দিকে বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল সেই বিতর্কিত ম্যাকমাহন লাইন। ১৯১৬-র সিমলা কন্‌ভেন্‌শন থেকে এই সীমারেখার উদ্‌ভব। তখনকার ব্রিটিশ ভারত ও তিব্বতের মধ্যে এই চুক্তি হয়। চীন কোনোদিন এই চুক্তির অংশ ছিল না। কাজেই ১৯৬২-তে এই ম্যাকমাহন লাইনের ভিত্তিতে চীন সীমারেখা লঙ্ঘন করছে কি না এই প্রশ্ন তোলার কোনো মানে ছিল না। কিন্তু এই কথাটা আজ তবু হয়তো উচ্চারণ করে বলছি। কিন্তু বাষট্টির দেশপ্রেমের আবহে এ কথা ফিশফিশ করে ছাড়া বলা যেত না। তাও আমরা একটু আধটু বলার চেষ্টা করতাম তখন। সেই প্রসঙ্গেই রাসেলের বইটা এবং নেভিল ম্যাক্সওয়েলের 'ইন্ডিয়া’জ চায়না ওয়ার' বই দুটো আমাদের খুব কাজে লেগেছিল। কাজে লাগত দু-একজন মাস্টারমশাইয়ের দু-একটা কথাও। যেমন আমাদের খুবই শ্রদ্ধেয় একজন মাস্টারমশাই তখন জোরের সঙ্গে বলতেন, অরুণাচল (বা নেফা-র) অন্তর্গত এমন কিছু জায়গা যা ভারত তখন নিজের বলে দাবি করছিল, সেসব জায়গা প্রথাগতভাবে কখনোই ভারতের ছিল না। উনি বলতেন মুদ্রাতাত্ত্বিক দিক থেকেও এসব কথার প্রমাণ হাজির করা সম্ভব। সেই মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির আড্ডাতে হতো এসব কথা। বুঝি আজ আর এইসব কথার কোনো মূল্য নেই। তবুও ভারতের তরফে চীনের প্রসঙ্গে যে স্বরভঙ্গিতে কথাগুলো উচ্চারণ করা হয় তার ক্ষীণতা খেয়াল করে এবং অনুরূপ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের বেলায় যে-তীব্রতা টের পাওয়া যায় এ দুইয়ের ফারাক মাথায় এলে আমাদের মাস্টারমশাইয়ের কথা বাষট্টি বছরের সময়কাল পেরিয়ে মনে পড়ে বইকি।

মনে পড়ে যখন আমাদের নেতাদের অলঙ্কৃত কূটনৈতিক ভাষার হুমকি শুনি। ওই চীন যুদ্ধের পরবর্তী সময়ের যেসব লেখাপত্র পাওয়া যায় তার মধ্যে তখনকার ভারত সরকারের আভ্যন্তরিক মন মেজাজের কড়ি ও কোমল ফারাকের যে গবেষণা তার মধ্যে কড়ির তরফে যে নামধামের সন্ধান মেলে সেখানে সামরিক স্তরে পাওয়া যায় ব্রিজমোহন কলের নাম। এমনকি ওই সময়ে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর নামও একটু আধটু উঠে আসে। এমনিতে তিনি যে খুব কড়া ধাতের মানুষ ছিলেন তা নয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় রণহুঙ্কারের মজা এই যে, কুরুবৃদ্ধ পিতামহ একবার সিংহনাদে মহাশঙ্খধ্বনি করলে অনেক শঙ্খ পণব গোমুখ আর ভেরী নিনাদিত হয়ে ওঠে। সত্যি কথা বলতে, আমাদের নেহরুকেও যুদ্ধোন্মাদ বলার কোনো মানে হয় না। এই ভারত-চীন যুদ্ধ ও কিউবা সংকটের মাত্র দু-বছর আগেই নেহরু সম্বন্ধে বারট্রাণ্ড রাসেল বলছেন, "Nehru is known to stand for sanity and peace in this critical moment of history. Perhaps it will be he who will lead us out of the dark night of fear,..." এই নেহরুর নেতৃত্বেই আমাদের ‘ফরোয়ার্ড পলিসি’ এবং তাতে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীরও সায়। রাষ্ট্রীয় পরিহাস আর কাকে বলে। তারিখ শিরোনাম ১১ এপ্রিল, ২০২৪। 'স্টেট্‌সম্যান' পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে, ভারত ও চীন দুই দেশই তাদের সম্পর্কে ‘স্থায়ী’ ও ‘শান্তিপূর্ণ’ সমাধান চায়। দুই দেশই জানে এবং একান্তভাবে মানে যে, ভারত ও চীনের মধ্যেকার সুসম্পর্ক শুধুমাত্র এই দুই দেশের জন্যই মঙ্গলজনক নয়, তা গোটা অঞ্চল ও সারা বিশ্বের স্থায়ীত্বের জন্যে জরুরি। এইসব অকিঞ্চিৎকর সুমধুর সুভাষিতাবলির আপাত উপলক্ষ্য হল আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল আমেরিকার 'নিউজউইক' ম্যাগাজিনে। মোদীর সেই সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গে চীনের সরকারি জবাব পাওয়া গেল সে দেশের বিদেশ মন্ত্রকের সরকারি মুখপাত্র শ্রীমতী মাও পিং-এর বক্তব্যে। জানা গেল ভারত ও চীন দু-দেশই কূটনৈতিক ও সামরিক পথে আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়েই ‘স্থায়ী’ ও ‘শান্তিপূর্ণ’ সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে বেজায় আগ্রহী। ধন্য বটে কূটনৈতিক মারপ্যাঁচ। আচ্ছা, মোদীর ওই ‘দারুণ জরুরি’ সাক্ষাৎকারের উত্তরে চীন যদি কিছু না বলত, তাহলে কী ক্ষতি হতো? তাহলে নথিবদ্ধ হয়ে থাকত যে ভারতই এক তরফা সুসম্পর্ক চায়, কিন্তু চীন তেমন আগ্রহী নয়। তা হতে দেওয়া চলবে না। সুসম্পর্কের আগ্রহে দু-জনকেই সমানে টক্কর দিতে হবে।

শুধু এইটুকু হলেও এক কথা। কূটনৈতিক লড়াই যে রীতিমতো উষ্ণতায় পৌছেছে তার আর এক নিদর্শন পাওয়া গেল। রাষ্ট্র সূচিত দেশপ্রেম। কেউ পিছিয়ে থাকলে চলবে না। বিরোধী দল কংগ্রেসের তরফে জয়রাম রমেশ যথেষ্ট তৎপর ও তীক্ষ্ণ প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন যে, মোদীর এই দুর্বল অবস্থানে চীন ভারতের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করতে আরও উৎসাহী হয়ে উঠবে। অনেক শঙ্খ পণব গোমুখ ভেরী বেজে উঠছে। চীনের প্রশ্নে মোদী, অমিত শাহ, রাজনাথ সিং সবার অবস্থানই দুর্বল ও ক্ষীণ, কোনো সন্দেহ নেই। পাকিস্তানের সীমান্তের দিকের প্রশ্ন হলে সঙ্গীত অন্য স্বরগ্রামে ধ্বনিত হতো। কিন্তু আজ তো খেয়াল রাখতে হবে যে ওয়েস্টফেলিয়া আদর্শের সার্বভৌমত্বের ধারণাই আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়েছে। কিন্তু আমাদের বর্তমান পৃথিবীর হালচাল দেখে তা বোঝবার উপায় নেই যে, আমরা ‘সূচ্যগ্র মেদিনী’র আদর্শ থেকে একটুও সরে আসার জন্যে কোনো প্রস্তুতি নিয়েছি।

মোদ্দা কথা এই। বাষট্টি বছর আগের যুদ্ধটাই চলছে। আমরা সামরিক ও কূটনৈতিক দুই পথেই শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাব। তাই যাচ্ছি। কয়েক বছর আগে চীন ভারত ভূখন্ডের জমি দখল করে রেখেছে, এই অভিযোগের উত্তরে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লোকসভাতেই উত্তর দিয়েছিলেন, সে তো অনেক পুরোনো ব্যাপার, নতুন কিছু নয়। সবই বেশ পরিষ্কার। শুধু নাছোড় ওয়েস্টফেলিয়ার স্মৃতি আমাদের পিছু ছাড়ে না।