আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২৪ ● ১৬-৩১ বৈশাখ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

দেশভাগ, বাস্তুহারা সমস্যা, মতুয়া ও নমঃশুদ্র সমাজের কথা

অশোক ভট্টাচার্য


১৯৪৭ সালে দেশভাগের মধ্য দিয়ে, ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান দুটি দেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। দেশভাগ জনিত কারণে ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গে আগমন ঘটেছিল ৭০ থেকে ৮০ লক্ষ হিন্দু বাঙালিবাস্তুহারার। যদিও এর পরেও বিভিন্ন সময়ে আরও কয়েক লক্ষ হিন্দু বাঙালিবাস্তুহারা এসেছিল পশ্চিমবঙ্গে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে বা পূর্ব পকিস্তানে চলে যায় ২০ লক্ষ মুসলমান বাঙালিবাস্তুহারা। এছাড়াও কয়েক লক্ষ বাঙালিবাস্তুহারাকে পাঠানো হয়েছিল দন্ডাকারণ্য ও আন্দামানে। এদের বেশিরভাগই ছিল নমঃশুদ্র ও নিম্নবর্ণের (হিন্দু জাত ও বর্ণ প্রথা অনুসারে)। পশ্চিমবঙ্গে যে বাস্তুহারারা এসেছিল তাদের মধ্যে ছিল হিন্দু উচ্চবর্ণ ও হিন্দু নিম্নবর্ণের মানুষ। যে সমস্ত বাস্তুহারারা পশ্চিমবঙ্গে সেই সময়ে এসেছিল, তাদের মধ্যে প্রথমে এসেছিল পূর্ববঙ্গের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা, যারা ছিল মূলতঃ ধনী ও মধ্যবিত্ত, জমিদার শ্রেণির বা চাকুরিজীবী বা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত। এই সমস্ত বাস্তুহারারা মূলতঃ কলকাতার আশেপাশে বাস্তুজমি ক্রয় করে এবং অনেকে পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের সাথে সম্পত্তির বিনিময় করে পশ্চিমবঙ্গে থাকতে শুরু করে। এরপর যারা এসেছিল তারা ছিল মূলতঃ শিক্ষিত ও নানা ধরনের পেশাজীবি, হিন্দু বাঙালিবাস্তুহারা। তৃতীয় ক্ষেত্রে ছিল মূলতঃ ছোট ছোট কারিগর, তাঁতি, শাঁখা নির্মাতা, মৃৎশিল্পী। এরা পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল, হিন্দু উচ্চবর্ণের মানুষদের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসার কারণে। তার কারণ এদের ওপরেই নানাভাবে নির্ভরশীল ছিল এই নিম্নবর্ণের বাস্তুহারারা। পশ্চিমবঙ্গে বাস্তুহারা হয়ে আসার পর এই দলের মানুষেরা বিভিন্ন স্থানে সরকারের কিছু আর্থিক সুবিধা নিয়ে শুরু করে নানা ধরনের ছোট ছোট ব্যবসা। চতুর্থ পর্যায়ে এসেছিল যারা তারা ছিল মূলতঃ নমঃশুদ্র, পৌন্ড্র যাদের বলা হতো অস্পৃশ্য। এরা আশ্রয় নিয়েছিল মূলতঃ সরকার নির্মিত বিভিন্ন বাস্তুহারা শিবিরে যেগুলি গড়ে উঠেছিল অবিভক্ত ২৪ পরগণা ও নদীয়া জেলায়। তখন এই বাস্তুহারা শিবিরগুলোতে ছিল না ন্যূনতম পরিষেবা ও সুযোগ-সুবিধা। অনেক হিন্দু বাঙ্গালি বাস্তুহারারা সেই সময়ে জবরদখল করা জমিতে কলোনি গড়ে তুলেছিল, যেগুলি আদতে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মিত্রশক্তির ফৌজিদের পরিত্যক্ত ব্যারাক বা জমি। বাস্তুহারা ক্যাম্পে যারা ছিল তাদের বেশিরভাগই ছিল হিন্দু নিম্নবর্ণের কৃষক বা হিন্দু জমিদারদের প্রজা। দেশভাগের পরে পশ্চিমবঙ্গে আত্মপ্রকাশ ঘটে ইউ. সি. আর. সি. সংগঠনের, যার নেতৃত্বে ছিলেন মূলতঃ কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা। তারা দাবি তোলে বাস্তুহারারা যে সমস্ত জবরদখল কলোনিতে বসবাস করছে সেই সমস্ত কলোনিগুলির স্বীকৃতি ও বাস্তুজমির পাট্টা ও অন্যান্য বিষয়ে। তারা সংগঠিত করে বড়ো বড়ো আন্দোলন। আবার ইউ. সি. আর. সি.-র নেতৃত্বাধীন কলোনি কমিটিগুলির উদ্যোগে কলোনির মধ্যে রাস্তা, স্কুল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদিও প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। এই সময়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার বেশ কিছু বাঙালিবাস্তুহারাদের দন্ডকারণ্য ও আন্দামানে স্থানান্তর করার নীতি গ্রহণ করে। ইউ. সি. আর. সি. ও বামপন্থী দলগুলি তার সর্বাত্মক বিরোধিতা করেন। ইউ. সি. আর. সি. দাবি তোলে পশ্চিমবঙ্গের ভূমি সংস্কারের, উদবৃত্ত জমিতে বাস্তুহারাদের বাস্তুজমি ও কৃষকদের কৃষিজমি বন্টন করতে হবে। এইভাবে বাস্তুহারাদের মধ্যে উঠে আসে বিভিন্ন বামপন্থী দলের নতুন তরুণ নেতৃত্ব। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন নির্বাচনে বামপন্থী দলগুলি বাস্তুহারাদের ব্যাপক সমর্থন পায়। ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনে ইউ. সি. আর. সি. তথা বাস্তুহারাদের ছিল বিরাট অবদান। ১৯৫৯ ও ১৯৬৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যের দাবিতে আন্দোলনেও ছিল ইউ. সি. আর. সি.-র বড় ভূমিকা। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে বামপন্থীরা পায় বাস্তুহারাদের ব্যাপক জনসমর্থন।

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত যে বিপুল সংখ্যক বাস্তুহারার আগমন ঘটে পশ্চিমবঙ্গে তাদের মধ্যে ছিল বিপুল সংখ্যক হিন্দু নিম্নবর্ণ তথা মতুয়া ও তপশিলি জাতির মানুষরাও। আগেই বলা হয়েছে যে, তারা মূলতঃ আশ্রয় নিয়েছিল বিভিন্ন স্থানে সরকারি রিফিউজি ক্যাম্পে। যে ক্যাম্পগুলিতে তারা আশ্রয় নিয়েছিল তাদের অবস্থা ছিল শোচনীয় ও বসবাসের অনুপযোগী। এই নিম্নবর্ণের হিন্দু বাঙ্গালিবাস্তুহারারা এসেছিল পূর্ববঙ্গের খুলনা, নোয়াখালি, যশোর, ফরিদপুর, ঢাকা, বরিশাল, ফিরোজপুর ইত্যাদি জেলা থেকে। এরা আসে মূলত ১৯৫১ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে। দেশভাগ বা বাংলাভাগের সময়ে নিম্নবর্ণের হিন্দু বাস্তুহারাদের একটি বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গে আসে বেশ কিছু বিলম্বে। এদের মধ্যে ছিল মতুয়া তথা তপশিলি জাতির মানুষরা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে বিপুল সংখ্যক বাস্তুহারা পশ্চিমবঙ্গে এসেছিল তাদের বড়ো অংশই ছিল মতুয়া ও নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের। মতুয়া সমাজের প্রধান নেতা প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর প্রথমে বাংলাভাগ বা দেশভাগের বিরোধিতা করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাবার। তপশিলি জাতির মানুষদের অন্যতম নেতা যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলও একই ধরনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কিছু জেলায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হবার ফলে ১৯৪৮ সালে পি. আর. ঠাকুর এবং ১৯৫০ সালে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গে। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল দু'বার অবিভক্ত বাংলার প্রদেশিক মন্ত্রীসভার এবং স্বাধীনতার পর ভারতের অন্তর্বতীকালীন মন্ত্রীসভা ও পাকিস্তানের মন্ত্রীসভার সদস্য হয়েছিলেন। পি. আর. ঠাকুর এবং বহু মতুয়া জাতির মানুষরা জমি ক্রয় করে অবিভক্ত ২৪ পরগণার জেলার ঠাকুরনগরে বসবাস করা শুরু করেন। পশ্চিমবঙ্গে এসে পি. আর. ঠাকুর নতুন করে গঠন করেন 'মতুয়া মহাসঙ্ঘ'। যোগেন মন্ডল গঠন করেন 'তপশিলি জাতি ফেডারেশন'-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখা। ১৯৫৭ ও ১৯৬২ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে পি. আর. ঠাকুর কংগ্রেস দলের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন এবং বিধান চন্দ্র রায়ের মন্ত্রীসভায় বাস্তুহারা পুনর্বাসন দপ্তরের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি কংগ্রেস দল ও মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করে অজয় মুখার্জীর নেতৃত্বে বাংলা কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে নদীয়া জেলার নবদ্বীপ লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। যদিও পরবর্তীকালে তিনি পুনরায় কংগ্রেস দলে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালের পরে তিনি কোনো নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি। তিনি সিদ্ধান্ত নেন মতুয়া মহাসংঘের কোনো সদস্য সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত থাকতে পারবেন না। অন্য দিকে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ১৯৬৩ সালে গঠন করেন একটি আর্থ-সামাজিক সংস্থা। এরপর তিনি যুক্ত হন 'আম্বেদকর সিডিউল কাস্ট সংগঠন'-এর সাথে। ১৯৬৭ সালে তিনি সিপিআই(এম) দলের সমর্থনে বারাসত লোকসভা আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।

এ প্রসঙ্গে আমি আসতে চাইছি বাংলাভাগ তথা দেশভাগ এবং তপশিলি জাতি তথা মতুয়াদের প্রসঙ্গে। ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে অবিভক্ত বাংলাভাগের সিদ্ধান্ত হয়। অবিভক্ত বাংলায় স্বাধীনতার দুই দশক আগেও রাজনীতি ছিল মূলতঃ দুটি ভাগে বিভক্ত। শুধু হিন্দু-মুসলমানেই নয়। একদিকে ছিল কংগ্রেস, যার নেতৃত্বে ছিল মূলতঃ উচ্চবর্ণের হিন্দুরা এবং হিন্দু মহাসভা। অন্যদিকে ছিল মুসলীম লিগ। তপশিলি জাতি ও মতুয়ারা ছিল উচ্চবর্ণ হিন্দু ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে। যাদের অনেকে ছিলেন দেশভাগের বিরুদ্ধে। অবিভক্ত বাংলার ৬০ ভাগ ভৌগোলিক এলাকা ছিল পূর্ববঙ্গে। এর মধ্যে ৬০ ভাগ মানুষ ছিল মুসলমান ৪০ ভাগ হিন্দু। মুসলিম লিগের দাবি ছিল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলিকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বাকি জেলাগুলিকে পশ্চিমবঙ্গে। তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এইচ. এস. সুরাবর্দি ও কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বোস তৃতীয় একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই প্রস্তাবে বাংলাভাগের বিরোধিতা করে বলা হয়েছিল অবিভক্ত বাংলা নিয়ে গঠন করা হোক একটি যুক্ত ও সার্বভৌম বাংলা। যা মেনে নেননি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ও কংগ্রেস নেতৃত্ব। তারা চেয়েছিলেন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ একটি পৃথক রাজ্য হোক এবং তা ভারতে অন্তর্ভুক্ত হোক। তপশিলি জাতি তথা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের নেতা পি. আর. ঠাকুর ও যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল বাংলাভাগের বিরোধিতা করেন এবং সুরাবর্দি ও শরৎচন্দ্র বসুর প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। তারা পূর্ব বাংলায় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও অচীরেই তারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গে। অবিভক্ত বাংলাতে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বাংলাভাগ ও পৃথক পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে ছিলেন যাতে কোন অবস্থাতেই বাংলার পশ্চিম অংশকে মুসলমানদের অধীনে থাকতে না হয়। ১৯৪৭ সালের ৭ই মে বাংলার বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবি, যাদের মধ্যে ছিলেন যদুনাথ সরকার, মেঘনাথ সাহা, রমেশচন্দ্র মজুমদার, শিশির কুমার মিত্র, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, তৎকালীন স্টেট অব ইন্ডিয়া, লন্ডনের, সচিবকে একটি চিঠি লেখেন। তাতে তাঁরা উল্লেখ করেন কেন বাংলাভাগ ও পৃথক পশ্চিমবঙ্গ দরকার। তাঁরা আরও উল্লেখ করেন ভারতেই দেশের পরম্পরা, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকতে পারে। সর্বশেষে দেশভাগ হয়, বিভক্ত হয় অবিভক্ত বাংলা। ৪০% ভৌগোলিক এলাকা যায় পশ্চিমবঙ্গের সাথে যার জনসংখ্যার ৭০% ছিল হিন্দু। অন্যদিকে ৬০% ভৌগোলিক এলাকা যায় পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যার ৭০% ছিল মুসলমান, বাকি ৩০% হিন্দু।

স্বাধীনতার আগে নিম্নবর্ণের হিন্দু বাঙালিরা সবসময় অনুভব করতেন উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অবজ্ঞা ও অসম্মানের। এই কারণে তাদের অনেকেই মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেননি। তারা মনে করতেন কংগ্রেস দল ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের পার্টি। উল্লেখ করা প্রয়োজন অবিভক্ত বাংলার অধিকাংশ কৃষিজমি ও জমি থেকে রাজস্ব আদায়ের উৎস ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদারদের হাতে, প্রজারা ছিল মূলতঃ মুসলমান ও নমঃশুদ্র। বাংলাভাগের প্রশ্নে তৎকালীন বাংলার আইনসভায় পৃথক পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ভারতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবের পক্ষে কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা, তিন জন কমিউনিস্ট সদস্য এবং ৩০ জন তপশিলি জাতির বিধায়কদের মধ্যে ২৫ জন সদস্য এই প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন। ৫ জন তার বিরোধিতা করেন। অবিভক্ত বাংলায় ব্রিটিশ শাসনে মতুয়া ও অন্যান্য তপশিলি জাতির মানুষরা ছিল অনেকটা সংঘবদ্ধ। সরকারের ওপর বিভিন্ন প্রশ্নে চাপ সৃষ্টি করার কিছু ক্ষমতা ছিল তাদের। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর তারা হয়ে পড়ে অনেক বেশি অসংঘবদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন। মুসলিম লীগ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। আরএসএস কর্তৃক মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার ঘটনার পর, কেন্দ্রীয় সরকার আরএসএস-কে বে-আইনি ঘোষনা করে। আরএসএস ও তার শাখা সংগঠনগুলি হয়ে যায় অনেক দূর্বল। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যে মুসলমান অধিবাসীরা পূর্ব পাকিস্থানে চলে যায় তারা ছিল মূলতঃ মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত ও পেশাজীবি। পশ্চিমবঙ্গে থেকে যায় মূলতঃ কৃষক বা কৃষিজীবি মুসলমানরা। ফলে মুসলিম লিগের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করার মতো ক্ষমতা হ্রাস পায় বলা যেতে পারে। ফলে স্বাধীনতার পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা অনেকটাই কমে যায়। অন্যদিকে এই সময়ে মতুয়া ও তপশিলি জাতির মানুষদের কণ্ঠ অনেক ক্ষীণ হয়ে যায়। তাদের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রতিবাদ ও অংশগ্রহণ অনেক কমে যায়। স্বাধীনতার আগে তপশিলি জাতি বা মতুয়া এবং রাজবংশীদের ছিল অনেক শক্তিশালী সংগঠন ও আন্দোলন। অবিভক্ত বাংলায় ১৯১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী মোট হিন্দুদের ১৭.৫৬% ছিল এই অংশের মানুষ। ১৯৩১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৮.৯৪%। সেই সময়ে সামাজিকভাবে নমঃশুদ্রদের করা হতো অবহেলা ও অবজ্ঞা। এমনকি তাদের হিন্দু মন্দিরেও প্রবেশ করার অধিকার ছিল না। চৈতন্যদেবের সমাজ সংস্কার এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ সংস্কার বা নবজাগরণের আন্দোলনের শিক্ষা, ধর্ম ও সামাজিক সংস্কারের কোনো প্রভাব পড়েনি মতুয়াদের উপর। এই সন্ধিক্ষণেই ঘটে হরিচাঁদ ঠাকুর (১৮১২-১৮৭৮) ও তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর-এর আবির্ভাব। তাঁরাই সূত্রপাত করেন বৈষ্ণবধর্মের বাইরে এক অ-আচরিক ধর্মীয় দর্শন (Non-Retualistic Religion Philosophy)। হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর মতুয়া নমঃশুদ্রদের মধ্যে সবচাইতে বেশি জোর দিয়েছিলেন শিক্ষার প্রসারের ওপর। শিশুদের মধ্যে শিক্ষাকে তাঁরা করলেন বাধ্যতামূলক। তাঁরা বললেন মতুয়াদের কেবলমাত্র কৃষিকাজ নয় করতে হবে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা। তাঁরা গুরুত্ব দিলেন গ্রামে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠার। উন্নয়ন কমিটি গঠন করে উন্নয়নমূলক কাজের সমস্তরকম কু-সংস্কার ও জাতিপ্রথা পরিহার করার। মতুয়া নমঃশুদ্ররা তাদের ওপর আর্থ-সামাজিক অবহেলার বিরুদ্ধে সংগঠিত হবার কথাও বলেন। ১৯১৫ সালে হরিচাঁদ ঠাকুরের পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন 'হরিচাঁদ মিশন'। ১৯৩২ সালে এই সংগঠনের নতুন নামকরণ হয় 'মতুয়া মহাসঙ্ঘ'। গুরুচাঁদ ঠাকুরের পৌত্র প্রমথরঞ্জন ঠাকুর হন মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রথম সভাপতি। ঘোষনা করা হয় তাদের লক্ষ্য হবে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সুরাহা, উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ এবং তাদের আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান। ১৮৭২ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত মতুয়া সমাজ এক আন্দোলন সংগঠিত করে যার মাধ্যমে তাঁদের 'চন্ডাল' প্রতিশব্দের পরিবর্তে বলা হয় 'তপশিলি জাতি ও মতুয়া'।

অবিভক্ত বাংলায় মতুয়া মহাসঙ্ঘ এক ধর্মীয়-সামাজিক সংস্কারের আন্দোলন শুরু করেছিল। তারা স্বদেশি আন্দোলনের উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রাধান্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ, মুসলমানদের সাথে নিয়ে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। মতুয়া মহাসঙ্ঘ, তপশিলি জাতির জন্যে আসন সংরক্ষণ ও তাদের জন্যে পৃথক ভোটার তালিকা প্রস্তুত করার দাবি জানায়। ১৯৩৭ সালে হয় বাংলায় প্রাদেশিক নির্বাচন। সেই নির্বাচনে ৩০টি আসন ছিল নমঃশুদ্রদের জন্যে সংরক্ষিত। ৩০টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে ১২টি আসনে জয়লাভ করেন গুরুচাঁদ ঠাকুরের অনুসারী মতুয়াপ্রার্থীরা। কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন মাত্র একজন প্রার্থী। এই ফলাফলের ফলে নমঃশুদ্রদের মধ্যে মতুয়াদের প্রভাব অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনের পর গঠিত হয় ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা। পি. আর. ঠাকুর ও অন্যান্য তপশিলি জাতি ও মতুয়া বিধায়ক সমর্থন জানায় ঐ মন্ত্রীসভাকে। কিন্তু ১৯৩৮ সালে তাঁরা ঐ মন্ত্রীসভা থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। তারা অভিযোগ করেন ঐ মন্ত্রীসভা তপশিলি জাতির স্বার্থে কোনো কাজ করছে না। পি. আর. ঠাকুর, যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, হেমচন্দ্র নস্কর, রসিকলাল বিশ্বাস প্রমুখ তপশিলি জাতির বিধায়করা গঠন করেন পৃথক 'ইন্ডিপিন্ডেন্ট সিডিউল কাষ্ট পার্টি'।

১৯৩৮ সালে গুরুচাঁদ ঠাকুরের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে মতুয়া মহাসঙ্ঘ আহুত এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। তিনি তখন ছিলেন কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি। ঐ সময়েই পি. আর. ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন সমস্ত তপশিলি জাতির বিধায়করা কংগ্রেস দলে যোগ দেন। পি. আর ঠাকুর তাঁর সমস্ত অনুসারীদের কাছে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের আবেদন জানান। ১৯৪১ সালে কংগ্রেসের সমর্থনে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ও ফজলুল হকের এক নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। কিন্তু ঐ মন্ত্রীসভায় কোনো তপশিলি জাতির মন্ত্রীকে স্থান না দেওয়ায় যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল মন্ত্রীসভার ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি গঠন করেন 'বেঙ্গল সিডিউল কাস্ট লীগ'। ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক আইনসভার সাধারণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে তপশিলি জাতিদের জন্যে সংরক্ষিত ৩০টি আসনের মধ্যে কগ্রেস দল জয়ী হয় ২৬টি আসনে, তপশিলি জাতি ও লীগ পায় মাত্র ১টি আসন, যেখানে নির্বাচিত হয়েছিলেন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। ১৯৪৬ সাল থেকেই বাংলা তথা দেশভাগ নিয়ে চর্চা ও আলোচনা শুরু হয়েছিল। কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে অ-বিভক্ত বাংলাকে ভাগ করে ভারতে অন্তর্ভুক্ত পৃথক পশ্চিমবঙ্গের দাবি জানান হয়। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল সমর্থন জানান যুক্ত সার্বভৌম বাংলার দাবির প্রতি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রস্তাবের মূল উত্থাপক ছিলেন তৎকালীন মুসলিম লীগ মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দী ও কংগ্রেস নেতা শরৎ চন্দ্র বসু। দেশভাগের পর যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী হন। ১৯৫০ সালে নোয়াখালি ও কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে তিনিও চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গে, সেইখানেই তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থেকে যান। তিনি পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বাস্তুহারা ও তপশিলি জাতির উন্নয়নের রাজনীতি ও আন্দোলনের সাথে। পি. আর. ঠাকুর প্রথমে দেশভাগের বিরোধিতা করে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও, ১৯৪৮ সালে তিনি ফিরে আসেন পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরে। পরবর্তীকালে তিনি যোগ দেন কংগ্রেস দলে। ১৯৫২ সালে তিনি নির্দল প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও পরাজিত হন। ১৯৫৭ ও ১৯৬২ সালে কংগ্রেস দলের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি জয়ী হন এবং বিধান চন্দ্র রায়ের মন্ত্রীসভার সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৬৭ সালে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে তিনি যোগ দেন বাংলা কংগ্রেস-এ। ঐ বছরেই তিনি লোকসভা নির্বাচনে বাংলা কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন। ১৯৭১ সালে একই কেন্দ্র থেকে লোকসভা নির্বাচনে পরাজিত হন সিপিআই(এম) প্রার্থী বিভা ঘোষ গোস্বামীর কাছে। পরে আবার তিনি কংগ্রেস দলে ফিরে এলেও আর কোনো নির্বাচনে তিনি জয়ী হতে পারেননি। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে মতুয়া নমঃশুদ্র, তপশিলি জাতি সংরক্ষিত আসনগুলিতে জয়ী হন সিপিআই(এম) বা বামপন্থী প্রার্থীরা। ২০০৩ সালে মতুয়া মহাসঙ্ঘ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, যে আইন ছিল বে-আইনি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ২০০৯ সাল থেকে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দানের দাবিকে পূরণ করার আশ্বাস দিয়ে বিভিন্ন নির্বাচনে লাভবান হন তৃণমূল কংগ্রেস দল। ২০১৯ সালের লোকসভা ও ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে লাভাবান হন বিজেপি প্রার্থীরা। তারই সর্বশেষ অধ্যায় ২০২৪ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। যা নিয়ে রয়েছে বিস্তর বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা। ২০১৯ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিজেপি-র সমর্থন ও প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিজেপি খুবই কৌশল করে মতুয়া, নমঃশুদ্র, রাজবংশী, আদিবাসীদের মধ্যে তাদের পরিচিতি ও আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদার দাবিকে তথা সামাজিক দাবিগুলিকে গৌণ করে হিন্দুত্বের বিষয়েই প্রাধান্য দেওয়া শুরু করে। ফলে এই সমস্ত জন গোষ্ঠীর মধ্যে হিন্দুত্বের নামে বিজেপি বেশ কিছুটা প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়। যদিও এর ফলে এই অংশের মানুষদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক দাবিগুলি গৌণ হয়ে যায়। বিজেপি হিন্দু মেরুকরণের রাজনৈতিক স্বার্থেই সিএএ (সংশোধিত) আইনে মুসলমানদের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ থেকে বাদ রেখেছে।

যদিও ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রতিটি বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের তপশিলি জাতির মানুষদের জন্যে সংরক্ষিত ৫৯টি আসনের মধ্যে ৫০ থেকে ৫২টি আসন পায় বামপন্থী দলগুলি। বিভিন্ন সময়ে মতুয়া মহাসঙ্ঘের অনেক কর্মকর্তারাও স্বীকার করেন, স্বাধীনতার পর বাঙালিবাস্তুহারাদের, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন নমঃশুদ্র ও মতুয়া, দন্ডকারণ্য ও আন্দামানে বা পশ্চিমবঙ্গে বাইরে পাঠাবার কংগ্রেস সরকারের উদ্যোগের সর্বাত্মক বিরোধিতা করেছিল বামপন্থী দলগুলি। শুধু তাই নয় ১৯৭১ সালে পূর্বে পাকিস্তান থেকে আগত বাস্তুহারাদের বিভিন্ন সমস্যা সুরাহার ও নানা উন্নয়নমূলক কাজে বামফ্রন্ট সরকারের ইতিবাচক ভূমিকার কথা বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করেছেন বাস্তুহারা ও নমঃশুদ্র, মতুয়া আন্দোলনের নেতৃত্ব। বামফ্রন্ট সরকারের বাস্তুহারাদের উন্নয়নমূলক কাজগুলির মধ্যে ছিল ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে চাষযোগ্য জমি বণ্টন, বিভিন্ন জবর দখল কলোনিতে বসবাসকারী বাস্তুহারাদের মধ্যে বাস্তুজমির শর্তহীন মালিকানা সত্ত্ব ও পাট্টা প্রদান, গরীব বাস্তুহারাদের নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা প্রদান, বাস্তুহারা কলোনিগুলির পরিকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। এর দ্বারা শুধু গরীব বাস্তুহারারাই নয়, উপকৃত হয়েছেন হাজার হাজার নমঃশুদ্র, মতুয়া ও গরীব বাস্তুহারারাও।

২০০৩ সালে তৎকালীন কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধন আইন প্রণয়ন ও বাস্তুহারা, বিশেষ করে মতুয়াদের বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আখ্যাত করে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার নীতির বিরুদ্ধে ও একই সঙ্গে এনআরসি ও ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে সিপিআই(এম) ও বামপন্থীরা সর্বাত্মক ও ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস দল বাস্তুহারা ও মতুয়াদের নানাভাবে ধাপ্পা দিয়ে চলেছে। বিজেপি ও আরএসএস, মতুয়া বা নিম্নবর্ণের হিন্দু তপশিলি জাতির মানুষদের ব্রাহ্মণ্যবাদ, মনুবাদ, উচ্চবর্ণের অবজ্ঞা ও অবহেলা ও সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে হিন্দু মুসলিম বিভাজনের আন্দোলনে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করছে। যার উদ্দেশ্য ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করা। এক সময় যে মতুয়া ও নিম্নবর্ণের মানুষেরা ব্রাহ্মণ্যবাদ ও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা নিপীড়িত ও অবহেলিত হয়েছিল সেই ব্রাহ্মণ্যবাদী ও মনুবাদী বিজেপি-কে অনেক মতুয়া ও নমঃশুদ্ররা সমর্থন করছেন যা অত্যন্ত বিস্ময়ের। অথচ মতুয়া সমাজ ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী। ১৮৭০ সালে অবিভক্ত বাংলার পূর্বাংশে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিরোধী সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সূত্রপাত হয়েছিল মতুয়া সমাজের আন্দোলন, যা আজ অনেকটাই বিজেপি ও তৃণমূলের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতির ফলে দিকভ্রষ্ট।