আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২৪ ● ১৬-৩১ বৈশাখ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

ঠেলার নাম বাবাজিঃ গ্যারান্টি দিলেন মোদিজি

সুখবিলাস বর্মা


২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে ধাপ্পাবাজ নরেন্দ্র মোদির নতুন ধাপ্পা মোদির গ্যারান্টি। ভাবটা এমন যেন মোদির মুখের গ্যারান্টিতেই সব কিছু পাওয়া হয়ে যাবে। ২০১৪ থেকে গত দশ বছরের ট্র্যাক রেকর্ড কি বলছে? ২০১৪-তে মোদি শুরু করেছিলেন ‘আচ্ছে দিনের’ স্বপ্ন দিয়ে। নির্বাচনের আগে প্রচারের বিপুল সম্ভারে ছিল শুধুই লম্বা চওড়া প্রতিশ্রুতি। সব কাগজের পাতা ভর্তি সুদিনের অ্যাড, চ্যানেলে চ্যানেলে সুবেশিতা গৃহিণী মায়েদের, মাঠে কৃষকদের, কারখানায় শ্রমিকদের স্বপ্নপূরণের কত প্রকল্পের বিজ্ঞাপন। তারপর ২০১৬-তে নোটবন্দি। প্রতিশ্রুতি আরও বড়ো, আরও ব্যাপক। দেশের সব কালো টাকা উদ্ধার হবে, প্রত্যেকের পকেটে ১৫ লাখ টাকা আসবে, দেশের উন্নয়ন তরতর করে এগিয়ে যাবে, বছরে দু' কোটি তরুণ-তরুণী কাজ পাবে ইত্যাদি। আরএসএস, বিজেপি, মোদি-শাহের পরম বন্ধুও আজ স্বীকার করেন যে সেইসব প্রতিশ্রুতির কোনটিই বাস্তবায়িত হয়নি, - বরং নোটবন্দির কুফল পড়েছে অর্থনীতির সর্বস্তরে, বিশেষ করে গ্রামের মানুষের উপরে, গ্রাম শহরের ছোটো মাঝারি ব্যবসায়ীদের উপরে, এমএসএমই সেক্টর অন্তর্ভুক্ত সবার উপরে। মরার উপর খাঁড়ার ঘা দিতে মোদি চাপিয়ে দিয়েছেন জিএসটি, সব কিছুর উপর ট্যাক্স, কেন্দ্রীয় সরকারি ট্যাক্স, রাজ্য সরকারি ট্যাক্স। সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। ট্যাক্স অনুপাতে সেবা নমো নমো।

বাংলার সব শ্রেণীর মানুষকে ঠকিয়েছে। বিজেপি দক্ষিণবঙ্গে ও সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে মতুয়া-অমতুয়া দলিত শ্রেণির অনুপ্রবেশকারীর নাগরিকত্বের ধুয়া তুলে, মিথ্যার ফাঁদে পাহাড়ের মানুষকে গোর্খাল্যাণ্ডের প্রতিশ্রুতিতে, উত্তরের রাজবংশীদেরকে উত্তরবঙ্গ আলাদা রাজ্য, কামতাপুরী ভাষার স্বীকৃতি, কোচবিহারকে কেন্দ্রশাসিত রাজ্য ইত্যাদি নানা ললিপপ দেখিয়ে ঠকিয়ে চলেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। এবারের নির্বাচনে উল্লিখিত সব কিছুতেই স্পিকটি নট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ।

২০১৪-তে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ভারতে বসবাসকারী মূলত দলিত শ্রেণিভুক্ত কিছু মানুষের সঙ্গে নাগরিকত্বের খেলা শুরু করলেন। ১৯৪৭ এবং ১৯৭১-এর আগে পরে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান/বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে যে মানুষজন শরণার্থী ছিন্নমূল, বাস্তুহারা, অনুপ্রবেশকারী ইত্যাদি নামে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যে আসতে বাধ্য হয় তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে এযাবৎকাল কোনও সমস্যা হয়নি। ২০০৩ সালে বিজেপি সরকার ইন্ডিয়ান সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট, ১৯৫৫-এ সংশোধনী এনে তাদেরকে ‘Illegal Migrants’ (অবৈধ পরিযায়ী) ঘোষণার মাধ্যমে সমস্যার সৃষ্টি করে। ২০১৬ সালে আর এক সংশোধনীর মাধ্যমে কিছু শর্তে মুসলিম সংখ্যালঘু ভিন্ন অন্য ধর্মের অবৈধ পরিযায়ীদের নাগরিকত্ব অর্জন করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। ২০১৬-র সংশোধনী বিল জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি (জেপিসি)-তে আলোচনান্তে ২০১৯-এ সংসদে পাশ হয় এবং রাষ্ট্রপতির তড়িঘড়ি অনুমোদনের পর প্রকাশিত হয় কুখ্যাত 'Citizenship Amendment Act (CAA), 2019'। মোদি-শাহ গ্যারান্টি দেন যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পার্শি অবৈধ পরিযায়ীরা নাগরিকত্ব লাভ করবে। এ ধরণের গ্যারান্টি দিয়ে বিজেপি বাংলা, আসাম, ত্রিপুরার ভোটে প্রভূত ভালো ফল করে। কিন্তু ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মার্চ পর্যন্ত কিছুই করতে না পেরে নির্বাচনের মুখে এসে CAA ,2019-এর রুলস্ (বিধি) প্রকাশ করে এই শ্রেণিভুক্ত মানুষকে ধোঁকা দেয় বিজেপি তথা মোদি-শাহ। বাংলার মতুয়া-অমতুয়া মানুষ বুঝতে পারল এই ধোঁকা। মোদির গ্যারান্টি মানে ধোঁকাবাজি। মিথ্যা কথা বলে নাগরিকত্বের অলীক প্যাঁচে ভোট আদায় করার গ্যারান্টি।

একইভাবে ২০২০-তে চলল কৃষি বিপনণ আইনের খেলা। বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কৃষক স্বার্থ বিরোধী তিনটি আইন পাশ হল। কৃষক আন্দোলনে সারা দেশ তোলপাড়। আন্দোলনকারী কৃষকদের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের অকথ্য অত্যাচার সব সীমা ছাড়িয়ে গেল। কিন্তু কৃষকদের অপ্রতিরোধ্য সংগ্রাম আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে গেল। আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে এল বিরোধী সব রাজনৈতিক দল। সরকার বাধ্য হল পাশ করা আইন বাতিল করতে। মোদি রাজী হলেন সব ফসলের জন্য এমএসপি অর্থাৎ ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা করতে। আন্দোলন তুলে নেওয়া হল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মোদির প্রতিশ্রুতি পালিত হল না। তাই নতুন করে আবার দেশে কৃষক আন্দোলনের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। দলিত, ওবিসি, স্থানীয় জনজাতির গরীব কৃষক শ্রমিকের প্রতি এটাই মোদির গ্যারান্টির নমু্না।

এরপর ২০২৩-এ শুরু হল অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের প্রকল্প। আরএসএস অনুগামী ব্রাহ্মণ্যবাদ/পুরোহিততন্ত্রের পূজারী, মোদিজী দেশের আপামর জনগণের কল্যাণকে উপেক্ষা করে মুষ্টিমেয় কিছু ব্রাহ্মণ পুরোহিতের লালন পালন কর্মসংস্থানের জন্যই রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন; যজ্ঞসর্বস্ব আচারাদির প্রচারে তিনি বদ্ধপরিকর। এক হাজার কোটি টাকা খরচে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা সহ রাম পথ, ভক্তি পথ, ধর্ম পথ ইত্যাদি ছাড়াও নির্মিত হয়েছে ১৬৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে অযোধ্যাধাম রেল জংশন, বাল্মিকী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বিজ্ঞাপন অনুসারে পরিকল্পনায় রয়েছে ২১৮০ কোটি ব্যয়ে বৈদিক সিটি নির্মাণ। ভারতবর্ষকে বৈদিক যুগে নিয়ে যাওয়ার এত আড়ম্বরে এই বিপুল পরিমাণ টাকা খরচে যে পরিকাঠামো তৈরি হয়েছে তার বেনিফিসিয়ারী প্রধানত ব্রাহ্মণ পুরোহিত এবং উঁচু জাতের মানুষজন। ২০২৪-এর শেষ নাগাদ সরকারি মতে এখানকার ৪ লক্ষ কোটি টাকার অনুমিত আয়ের বেনিফিশিয়ারিও হবেন প্রধানত পুরোহিতকুল।

উগ্র হিন্দুত্বের প্রতীক রাম মন্দির নির্মাণের পর মোদি ভেবেছিলেন সংখ্যাগুরুর শাসনে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠায় কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছেন এবং ২০২৪-এর নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক আসন নিয়ে জয়লাভ শুধু সময়ের অপেক্ষা। ফয়জাবাদ অযোধ্যার বিজেপি এমপি লাল্লু সিং সহ মোদির কিছু হিন্দুত্ববাদী শাকরেদ আগামী নির্বাচনে কমপক্ষে ৪০০ আসন দখলের দাবি করছেন, যাতে আগামীতে দেশের সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও হিন্দু রাষ্ট্র গঠন সহজ হয়ে ওঠে। বিজেপির এই ধরনের প্রচারের বিরূদ্ধে রাহুল গান্ধী প্রমুখ বিরোধীগণ বসে নেই; বিজেপির নেতানেত্রীদের বক্তব্য তুলে ধরে বিরোধী জোট ‘ইণ্ডিয়া’র পক্ষ থেকে তাঁরা দেশের কোণে কোণে প্রচার করছেন আর একবার সরকার গঠন করতে পারলে মোদি-অমিত শাহ সংসদীয় গণতন্ত্রের মূলোচ্ছেদ করবেন। বিরোধীদের প্রচারে ব্যাপক সাড়া মিলছে এবং বিজেপি ও মোদি-শাহ প্রমাদ গুণছেন। তাই এবার তাঁরা শুরু করলেন নতুন ধাপ্পা - মোদির গ্যারান্টি / বিজেপির গ্যারান্টি। খবরের কাগজের পাতা জুড়ে “বিজেপির সংকল্প মোদীর গ্যারান্টি” শীর্ষক বিজ্ঞাপনে ছাপানো গ্যারান্টিগুলো হল - গরীবের সেবা, মধ্যবিত্তের সেবা, শ্রমিকের সঙ্গে, ঐতিহ্য এবং উন্নয়ন, কৃষকের সম্মান, তরুণদের কর্মসংস্থান, ভারতকে ম্যানুফ্যাকচারিং-এর গ্লোবাল হাব, পরিকাঠামোর ভিত্তি সুদৃঢ় করা, নারীশক্তিকে সম্মান, সুশাসনে সমৃদ্ধ ভারত, বঞ্চিতদের অধিকার, প্রবীণ নাগরিক। মোদি-বিজেপির এই প্রতিশ্রুতিগুলি নতুন নয়, - ২০১৪ এবং ২০১৯-এর নির্বাচনের আগেও এগুলি ছিল, কিন্তু কোনটাই কার্যকরী হয়নি, বরং গরীব কৃষক শ্রমিক মধ্যবিত্ত প্রবীণ বঞ্চিত তরুণ নারীদের ক্ষেত্রে উল্টোটাই ঘটেছে। তাদের উপর বঞ্চনা, অন্যায় অত্যাচার অবিচার অনেকগুণ বেড়েছে। তবে সব কিছুকে টেক্কা দিল মোদির মুখে ভারতের সংবিধানের উপর হস্তক্ষেপ না করার গ্যারান্টি এবং মোহন ভাগবতের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অমিত শাহের মুখে সংরক্ষণে হস্তক্ষেপ না করার গ্যারান্টি। মিথ্যার পরাকাষ্ঠা দুটোই হল মরণকালে হরিনামের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

মোদি বিজেপি সরকারের সংবিধানের উপর হস্তক্ষেপ তো একেবারে সাম্প্রতিকতম ঘটনা। বিনা অপরাধে দুই কক্ষ মিলে ১৪৪ জন বিরোধী সাংসদকে বহিষ্কার করে, 'মনু সংহিতা'র ধাঁচে তৈরি 'দণ্ড সংহিতা' যথা, ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা ২০২৩’ (IPC, 1860), ‘ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা, ২০২৩’ (CrPC, 1898) ও ‘ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম, ২০২৩’ (Indian Evidence Act, 1872) এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে আইন ইত্যাদি বিল বিনা বাধায় পাশ করিয়ে নেওয়া হল। হস্তক্ষেপের সবে শুরু। মোদি-শাহ-বিজেপির গ্যারান্টিকে বিশ্বাস করলে এভাবেই বাষ্পীভূত হবে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক, পার্লামেন্টারি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা।