আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২৪ ● ১৬-৩১ বৈশাখ, ১৪৩১

সম্পাদকীয়

প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের নেপথ্যে


দেশের প্রধানমন্ত্রী সরাসরি সাম্প্রদায়িক বক্তব্য রাখছেন। সরাসরি বলছেন যে ভারতের মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী, তারা বেশি সংখ্যায় সন্তানের জন্ম দেয়। তিনি বলছেন যে কংগ্রেস দল ক্ষমতায় এলে নাকি হিন্দুদের সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তা মুসলমানদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হবে। প্রত্যেকটি বক্তব্য শুনে একটা শিশুও বলে দিতে পারে যে কথাগুলি নির্বাচনী আচরণবিধির বিরুদ্ধে যায়, ধর্মের নামে ভোট নেওয়া, অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে জনগণকে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া সবই ভারতের আইনের বিরুদ্ধে। কিন্তু কথাগুলি তো আর পাড়ার কোনো নেতা বলছেন না, বলছেন দেশের ‘মহান’ প্রধানমন্ত্রী। অতএব, নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ। তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন না। কিন্তু, আম আদমি পার্টির প্রচার গানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, তাকে পরিবর্তন করার নির্দেশ জারি করার সময় অবশ্য নির্বাচন কমিশনকে বেশি সময় ব্যয় করতে হয়নি।

অন্যদিকে, সুরাট লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী ব্যতিরেকে বাকি সমস্ত প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে, প্রত্যক্ষভাবে বিজেপি-র অঙ্গুলিহেলনে। নির্বাচন হওয়ার আগেই বিজেপি সুরাট আসনটি জিতে গেছে। ইন্দোরে কংগ্রেসের ঘোষিত প্রার্থী নির্বাচনের দিন কয়েক আগে পদত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। বিজেপি তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদায় তাদের দলে স্বাগত জানিয়েছে। অতএব মনে করা যেতে পারে যে ইন্দোর আসনটিও নির্বাচন হওয়ার আগেই বিজেপি জিতে নিয়েছে, কংগ্রেসের প্রার্থীকে ভাঙিয়ে। কিন্তু মহামহিম নির্বাচন কমিশনের চোখে বোধহয় এই প্রবণতাগুলি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা যারা পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির বাসিন্দা আমাদের এই ঘটনাগুলিকে চেনাপরিচিত বলেই মনে হয়। কারণ আমাদের রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ‘দামাল’ ভাইয়েরা পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীদের জোর করে মনোনয়ন প্রত্যাহার করানো বা তৃণমূলে তাদের নাম লেখানোয় এক অসামান্য পারদর্শীতা ইতিমধ্যেই দেখিয়েছে। বিজেপি আরও বড় পার্টি। তারা আগেই প্রমাণ করেছে যে বিরোধীরা ক্ষমতায় এলেও বিধায়কদের কিনে নিয়ে সরকার গড়া কোনো ব্যাপার নয়। এবারে তারা নতুন পদ্ধতিতে হাত পাকাচ্ছে - লোকসভা নির্বাচন হওয়ার আগেই বিরোধী প্রার্থীকে প্রত্যাহার করানো বা নিজেদের দলে সামিল করা। এই বিষয়ে তারা যে আমাদের রাজ্যের শাসকদল দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন এই দাবি করলে তা মিথ্যা প্রমাণ করা কঠিন হবে।

প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি সাম্প্রদায়িক ভাষণ এবং বিজেপি-র এইরূপ মরিয়া কার্যক্রমের নেপথ্যে রয়েছে বিগত দুই পর্যায়ের লোকসভা নির্বাচনের ভোটদানের প্রবণতা। ১৯ এপ্রিল এবং ২৬ এপ্রিল এই দুইদিনে মোট ১৮৯টি লোকসভা আসনে ভোট নেওয়া হয়েছে। এই দুই পর্যায়েই ভোটদানের হার বিগত ২০১৯ সালের নির্বাচনের তুলনায় বেশ কিছুটা কম। বিশ্লেষকদের মতে আসলে বিজেপি বা বিরোধীদের কারোর পক্ষেই কোনো তথাকথিত হাওয়া নেই। ভোটদাতারা হয়ত ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার মতন উৎসাহ পাচ্ছেন না। এই খবরে স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি-র চিন্তা বেড়েছে। এইবার ৪০০ পার, এই স্লোগান নিয়ে তারা নির্বাচনী যুদ্ধে নেমেছেন। কিন্তু বাড়তে থাকা বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, মানুষের মনে বিজেপিকে নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। তদুপরি, বিগত ১০ বছর ধরে সরকার চালানোর পরেও মানুষের জন্য এমন কোনো কাজের কথা বিজেপি বলতে পারছে না, যা মানুষের মনে দাগ কেটেছে বা তাদের সমস্যার সুরাহা করেছে। এরপরেও বিজেপি-র রাজনীতিতে মোদী বিগত দুটি লোকসভা নির্বাচনে এমন কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বা তাকে ইস্যু বানিয়েছেন যা বিজেপির নির্বাচনী বৈতরণী পেরোতে সাহায্য করেছে। ‘আচ্ছে দিন’, ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’, ‘ঘর মে ঘুসকে মারুঙ্গা’ ইত্যাদি স্লোগান ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে বিজেপির জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু এই নির্বাচনে এখন অবধি বিজেপি জাতীয় স্তরে কোনো রাজনৈতিক স্লোগান বা ইস্যুকে মানুষের সামনে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরতে পারেনি। এই পরিস্থিতি আর কেউ বুঝুক আর না বুঝুক মোদী বুঝেছেন। অতএব তিনি ২০০২ সালের গুজরাট নির্বাচন থেকে যেই শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন, সেই নীতিই অবলম্বন করেছেন - উগ্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতির মাধ্যমে হিন্দুত্বের নামে, মুসলমানদের বিরোধীতা করে হিন্দুদের ভোটকে এককাট্টা করার চেষ্টা করছেন। নির্বাচনে জেতার জন্য এমন কোনো কথা নেই, যা মোদী বলতে পারেন না। তাই সরাসরি একটি ধর্মের মানুষকে হেয় করা বা তাদের টার্গেট করে ভোট চাওয়া মোদীর কাছে কোনো বিষয় নয়। ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’-এর হৃদয় যে আসলে সাম্প্রদায়িকতা এবং ঘৃণার বিষে ভরা তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার আড়ালে মোদী আসলে আরেকটি কথা বলছেন যা অনেকের চক্ষু এড়িয়ে যাচ্ছে। মোদী বারংবার কংগ্রেসের ইস্তেহারকে আক্রমণ করছেন, বলছেন যে এই ইস্তেহারে নাকি এমন সব কথা লেখা আছে যা পাকিস্তানের জন্মদাতা মুসলিম লীগের দ্বারা অনুপ্রাণিত। এই ইস্তেহারের সমালোচনা করতে গিয়েই তিনি হিন্দু মহিলাদের থেকে মঙ্গলসূত্র কেড়ে নিয়ে নাকি মুসলমানদের মধ্যে বিতরণ করা হবে কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে, এইসব কথা বলছেন। কিন্তু যেখানে তিনি ৪০০ পার করবেন বলে রণহুঙ্কার দিচ্ছেন, সেখানে কংগ্রেসের ইস্তেহারকে এত গুরুত্ব তাঁকে দিতে হচ্ছে কেন? কেন সেই ইস্তেহারের সমালোচনা করার নামে একগুচ্ছ মিথ্যা এবং সাম্প্রদায়িক বক্তব্য তাঁকে রাখতে হচ্ছে?

এর উত্তর নিহিত আছে কংগ্রেসের ইস্তেহারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতিতে। প্রথমত, কংগ্রেস ঘোষণা করেছে যে ক্ষমতায় এলে তারা জাতিভিত্তিক জনগণনা করবে। স্বচ্ছ সমীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন জাতির আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে বোঝা সম্ভব হবে এবং তার ভিত্তিতে কংগ্রেস সামাজিক ন্যায় এবং সংরক্ষণের নীতিকে আরো বিস্তৃত করবে এই কথাও ইস্তেহারে লেখা আছে। বিজেপি সুস্পষ্টভাবে জাতিভিত্তিক জনগণনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এর কারণ খুব মৌলিক। মুখে যতই বিজেপি সামাজিক ন্যায়ের কথা বলুক না কেন, আসলে তারা দেশের সম্পদ এবং সুবিধার উপর উচ্চবর্ণের একচেটিয়া অধিকার বজায় রাখারই পক্ষে। কিন্তু সমস্যা হল যে উচ্চবর্ণরা আসলে দেশে সংখ্যালঘু। অতএব, আরএসএস-বিজেপি-র তথাকথিত হিন্দু জাগরণ বা হিন্দুদের এককাট্টা করতে হলে দলিত, আদিবাসী বা ওবিসিদের সমর্থন লাগবে। তারা যদি নিজেদের হিন্দু বলে স্বীকার না করে, তাহলে বিজেপি-র হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে যে রাজনীতি করছে তা ভেঙে যাবে। অতএব, দলিত, আদিবাসী ও ওবিসিদের মুসলমান বিদ্বেষ এবং কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে আরএসএস-বিজেপির ছাতার তলায় রাখা বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতির জন্য আবশ্যিক। কিন্তু যদি দেশে জাতিভিত্তিক জনগণনা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে যদিও উচ্চবর্ণের সংখ্যা অনেক কম কিন্তু দেশের আয় এবং সম্পদের একটি বিশাল অংশের মালিক তারা। এই সত্যটি সামনে চলে এলে হিন্দু ধর্মের নামে দলিত, আদিবাসী এবং ওবিসি অংশকে একত্রিত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই বিজেপিকে জাতিভিত্তিক জনগণনার বিরোধিতা করতে হয়। কিন্তু তা সরাসরি করলে দলিত অংশের সমর্থন হারানোর ভয় রয়েছে। তাই সরাসরি কংগ্রেসের ইস্তেহারকে পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে তাকে মুসলমানদের ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হিসেবে প্রমাণ করার দায় নিতে হয় স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রীকে।

দ্বিতীয়ত, কংগ্রেস তার ইস্তেহারে আয় এবং সম্পদের বৈষম্য কমানোর জন্য উপযুক্ত নীতি গ্রহণ করার কথা বলেছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এই প্রসঙ্গে বলেছেন যে ক্ষমতায় এলে একটি সমীক্ষার মাধ্যমে তারা এই বৈষম্যের মান ও আকার বোঝার চেষ্টা করে তার ভিত্তিতে উপযুক্ত নীতি গ্রহণ করবে। আর্থিক বৈষম্য কমানোর নীতি গ্রহণ করার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। তবু মোদী এই নীতিকে সমালোচনার নামে হিন্দুদের সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হবে ইত্যাদি কথা বললেন। ইতিমধ্যে স্যাম পিত্রোদা পৈতৃক সম্পত্তি হস্তান্তরের উপরে কর আরোপ করার কথা বলে বিতর্ক আরও বাড়িয়েছেন। এই নীতি কতটা যুক্তিপূর্ণ সেই নীতি নিয়ে আলোচনা করার পরিসর এই সম্পাদকীয়তে নেই। কিন্তু এই নীতি নিয়ে বিতর্কের নামে যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ মোদী ছড়ালেন তা বুঝতে হলে মোদীর অর্থনৈতিক নীতি বুঝতে হবে।

আদানি-আম্বানিদের প্রভূত পরিমাণ সুবিধা প্রধান করে যে ধান্দার ধনতন্ত্র মোদী দেশে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, সেই ধনতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বৈষম্যের বৃদ্ধি। কিন্তু বাড়তে থাকা আর্থিক বৈষম্য সাধারণ মানুষের মনে মোদী বিরোধী ভাবনা জাগাতে পারে। অতএব তাকে আর্থিক বৈষম্যের সঙ্গে ধর্মকে মেলাতেই হবে। আসলে মোদী অসংখ্য গরিব এবং মধ্যবিত্ত হিন্দুদের মনে তাদের সম্পত্তি চলে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে ধান্দার ধনতন্ত্র যাতে দেশে চলে এবং আদানি-আম্বানিদের সম্পদ আরও বাড়ে তার ব্যবস্থা করতে চান। এই কথা সরাসরি বললে মানুষ ক্ষেপে উঠবে। তাই শত্রু হিসেবে দেখানো হচ্ছে মুসলমানদের, আসলে আড়াল করা হচ্ছে তার ধনীদের পক্ষে এবং গরিবদের বিপক্ষে নেওয়া নীতিসমূহকে।

এই সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের মধ্যেও হালকা আলোর দিশা দেখা যাচ্ছে। আর্থিক বৈষম্য, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, জাতিভিত্তিক জনগণনা ইত্যাদি ইস্যুগুলি যে মানুষের মনে দাগ কাটছে, মোদীর বেলাগাম কংগ্রেসের ইস্তেহারকে আক্রমণ তার প্রমাণ। আগামী পর্যায়ের নির্বাচনের আগে এই বিষয়গুলি নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রচার গড়ে তুলুক বিরোধীরা। ভরসা এই যে নিজের এজেন্ডায় নয়, মোদীকে কথা বলতে হচ্ছে বিরোধীদের এজেন্ডায়। এই ভরসা নিয়ে আগামী একমাসের লড়াই সঠিকভাবে লড়া গেলে মোদীকে রাজনৈতিকভাবে এক বিপুল ধাক্কা দেওয়া সম্ভব। বিরোধীদের কাছে আবেদন, সেই প্রয়াসে সবাই একত্রিত থাকুন।